জাতীয় পার্টির (একাংশ) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলায়য়ি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। বৃহস্পতিবার সকালে গুলশানের বাসভবনে (রোড-৬৮, বাসা-২) তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর দ্রুত রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আনা হলে কর্ত্যবরত চিকিৎসক সাড়ে ৭টায় তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে কাজী জাফরের জানাযার নামাজ অনুষ্টিত হবে। তার এপিএস কামরুজ্জামান রনি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তার লাশ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে দাফন করা হবে। তবে দাফনের সময় এখনো ঠিক হয়নি বলেও জানান তিনি।
তার মৃত্যুর খবর শুনে ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে আসেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মাদ ইউনূস, পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান, এক সময়ের সহকর্মী বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) প্রধান শফিউল আলম প্রধান, বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি, জাতীয় পার্টির (জাফর) সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামাল হায়দার, প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. টি আই এম ফজলের রাব্বী চৌধুরী, এসএমএম আলম, আহসান হাবিব লিংকন ও আব্বাস আলী খান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রমসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।
এদিকে কাজী জাফর আহমেদের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছে বিএনপি। দলের গণমাধ্যম শাখার কর্মকর্তা শায়রুল কবীর খান জানান, কাজী জাফর আহমদের মৃত্যুতে চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শোকপ্রকাশ করেছেন।
ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে রাজনীতি অঙ্গনে প্রবেশ এই নেতার। ১৯৫৫ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন। রাজশাহী জেলা ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক এবং রাজশাহী কলেজ সাহিত্য মজলিশের মুখপাত্র সাহিত্যিকীর সম্পাদক হিসেবে তার কর্মময় রাজনীতিতে পদচারণা শুরু করেন।
১৯৩৯ সালের ১ জুলাই কুমিল্লার প্রখ্যাত চিওড়া কাজী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এম এ (ইতিহাস) পাস করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এম এ এবং এল.এল.বি. কোর্স সম্পন্ন করা স্বত্ত্বেও কারাগারে চলে যাওয়ায় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারেননি।
কাজী জাফর আহমদ ১৯৫৯-১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি ১৯৬২-১৯৬৩ সালে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (এপসু) সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন ও শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে কাজী জাফর আহমদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রজীবন শেষে তিনি শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। ১৯৭২-১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাধারণ সম্পাদক। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন ছিলেন ন্যাপের চেয়ারম্যান। এরপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনাইটেড পিপলস্ পার্টির (ইউপিপি) প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে চেয়ারম্যান হিসেবে সক্রিয়ভাবে পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্ব ও জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী হন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির জন্মলগ্ন থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। ১৯৮৬-১৯৯০ সালে জাতীয় পার্টির সরকারে পর্যায়ক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বন্দর-জাহাজ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক উপদেষ্টা, ১৯৮৯-১৯৯০ সালে বাংলাদেশের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
১৯৮৬-১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের উপনেতা ও ১৯৮৯-১৯৯০ সালে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতা। ১৯৮৬-১৯৯৬ পর্যন্ত পরপর তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তিনি সে দায়িত্বপালন করে আসছিলেন।