বিয়ে বলুন আর জন্মদিন। উপহার হিসেবে সোনার প্রচলন বেশ পুরোনো। দিন যতই যাচ্ছে, সোনার চাহিদাও তত বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দামও। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেও দাম ওঠানামা করছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আমদানি-রপ্তানির সম্পর্ক নেই। সোনার দাম, এটির বাজার, চাহিদা, জোগানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আমিন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি কাজী সিরাজুল ইসলাম
বেশ কিছুদিন ধরে সোনার দামের ওঠানামা হচ্ছে। একধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে সোনার বাজারে। এটি কেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: দামের ঘন ঘন ওঠানামার মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছুদিন ধরে সোনার দামের ওঠানামা চলছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখেই দেশের বাজারেও আমাদের দাম বাড়াতে বা কমাতে হচ্ছে। গ্রাহকেরাও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে দামের ওঠানামাকে পছন্দ করে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখনই দাম কমে, তখনই গ্রাহকেরা আমাদের কাছে এসে প্রশ্ন করে আমরা কখন দাম কমাব। এ ছাড়া চাহিদা ও জোগানের কারণেও কিছু সময় দাম ওঠানামা করে।
কিন্তু গ্রাহকের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আপনারা দ্রুত দাম বাড়িয়ে দেন। আবার কমানোর ক্ষেত্রে সময় নেন বেশি। এ ছাড়া দেশের বাজারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণও নয়। এটি কেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: অভিযোগটি পুরোপুরি সত্য নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেই দেশের বাজারে সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেমন দাম বাড়াই না, ঠিক তেমনি কমলেও সেটি তাৎক্ষণিকভাবে কমানো হয় না। কিছুদিন আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করেই আমরা দেশের বাজারে দাম বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নিই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখবেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেও দাম কমানোর বিষয়টি নিয়ে বেশি কথা হয়। কিন্তু দাম বাড়ানোর বেলায় সেটি হয় না। আর দেশের বাজারে সোনার দাম বেশি থাকার একটি বড় কারণ চাহিদা ও জোগানের মধ্যকার ঘাটতি।
কিন্তু সোনার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে দাম বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে কেন আন্তর্জাতিক বাজারকে অনুসরণ করা হয়?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: হ্যাঁ, এ কথা ঠিক। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমাদের সোনার বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা সোনা আমদানি-রপ্তানি কোনোটিই করি না। তা সত্ত্বেও দামের ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারকে অনুসরণ করি। কারণ গ্রাহকের চাহিদা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকেরা এসে আমাদের কাছে দাম কমানোর বিষয়ে জানতে চান। এটি আসলে অনেকটা মানসিক ব্যাপার।
.প্রথম আলো: বিদেশ থেকে সোনা আমদানি-রপ্তানি নেই। অর্থাৎ সোনার আনুষ্ঠানিক কোনো বাজারব্যবস্থা নেই, অথচ যুগের পর যুগ সোনার ব্যবসা চলছে। এটি কীভাবে?
সিরাজুল ইসলাম: আনুষ্ঠানিক কোনো আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম তো নেই-ই; পাশাপাশি আমাদের দেশে সোনার বাজারের জন্য আলাদা কোনো নীতিও নেই। অথচ আমরা যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছি, তারা দীর্ঘদিন ধরে একটি নীতির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। সরকারের বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার করছি। বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তাঁরা সোনার বাজারের জন্য একটি নীতি করে দেবেন।
নীতি করা হলে তাতে গ্রাহকের কী সুবিধা আর আপনাদেরই বা কী সুবিধা হবে?
সিরাজুল ইসলাম: দেখুন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সোনার বাজারের জন্য আলাদা নীতি আছে। সে দেশের সরকার নিয়ম করে কয়েকটি ব্যাংককে সোনা আমদানির জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ওই সব ব্যাংক বিদেশ থেকে সোনা আমদানি করে। পরে ব্যাংকের কাছ থেকে সেই সোনা ব্যবসায়ীরা কিনে নেন এবং তার বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কর দেন। আমাদের দেশেও সেই ধরনের একটি ব্যবস্থা করা গেলে তাতে এ খাতে জবাবদিহি তৈরি হবে, সরকারেরও রাজস্ব আদায় সহজ হবে। নীতি থাকলে গ্রাহকের যে সুবিধাটি হবে, তা হলো আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সুবিধা তাঁরা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে পারবেন।
আপনি বলছেন, বিদেশ থেকে সোনা আমদানির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাহলে দেশের বাজারে সোনার সরবরাহ কোথা থেকে আসছে?
সিরাজুল ইসলাম: দেশের সোনার বাজারের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, সেগুলোর সবই অনুমাননির্ভর। আমাদের কাছে অনুমাননির্ভর যে হিসাব রয়েছে, তাতে দেশের বাজারের চাহিদার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পূরণ হয় পুরোনো সোনা দিয়ে। প্রতিনিয়ত অনেকেই পুরোনো সোনা ভাঙিয়ে নতুন ডিজাইনের স্বর্ণালংকার তৈরি করছেন। আবার অনেকে টাকার প্রয়োজনে পুরোনো সোনা বিক্রি করেন। এভাবে পুরোনো সোনা সংগ্রহ করে সেগুলো ভাঙিয়ে আমরা নতুন নতুন ডিজাইনের স্বর্ণালংকার তৈরি করে চাহিদা মেটাচ্ছি।
যদি আপনার হিসাবটিকেই ধরি, তাহলে চাহিদার বাকি ৪০ শতাংশ সোনা কোথা থেকে, কীভাবে আসছে?
সিরাজুল ইসলাম: এরও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। যতটা ধারণা করতে পারি, তাতে মনে হয় অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৪০ শতাংশ সোনা বৈধ ও অবৈধ পথে বিদেশ থেকে আসে। আনুষ্ঠানিক আমদানি-রপ্তানির ব্যবস্থা না থাকার পরও বৈধ পথেও প্রতিনিয়ত সোনা বিদেশ থেকে আসছে।
সেটি কীভাবে?
সিরাজুল ইসলাম: বর্তমানে অনেক বাংলাদেশি বিদেশে বসবাস করেন। আবার প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। তাঁরা যখন দেশে আসেন, তখন সঙ্গে করে কিছু সোনা নিয়ে আসেন। বিদেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা আনার সরকারি বিধানই রয়েছে। আমার জানামতে, তিন হাজার টাকা কর দিয়ে বিদেশ থেকে যেকোনো ব্যক্তি ১০০ গ্রাম সোনা সঙ্গে আনতে পারেন। এভাবেই বিদেশে বসবাসকারী বা বিদেশ ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বৈধ পথে কিছু সোনা আসে। এর বাইরে কিছু হয়তো অবৈধ পথেও আসছে, যার সঠিক হিসাব আমাদের জানা নেই। মাঝেমধ্যে সরকার বিপুল পরিমাণ সোনা আটক করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরে সেগুলোও দেশের বাজারে বিক্রি করা হয়।
দেশের বাজারে প্রতিবছর কী পরিমাণ সোনার চাহিদা রয়েছে, তার কোনো হিসাব আছে?
সিরাজুল ইসলাম: অভ্যন্তরীণ চাহিদার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির একটি আনুমানিক হিসাব আছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২৬০০ ভরি স্বর্ণালংকার বিক্রি হয়। এই হিসাব সমিতির সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর। সমিতির বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে সোনার অনেক দোকান রয়েছে, যেগুলোর হিসাব কারও কাছে নেই।
আপনি নিজে অনেক দিন ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আপনার অভিজ্ঞতায় এ বাজারটি কতটা বড় হয়েছে এবং সোনার প্রচলন কেমন বেড়েছে?
সিরাজুল ইসলাম: ১৯৬৬ সাল থেকে আমি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি বাজারটিও বড় হয়েছে। একসময় বিয়ে, জন্মদিন বা সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সোনার প্রচলন ছিল। এখনো সেটি আছে। তবে এর পাশাপাশি এখন অনেকে আপত্কালীন বিনিয়োগ হিসেবেও সোনা মজুত রাখেন।
: কারিগর থেকে শুরু করে খুচরা ও পাইকারি সোনার ব্যবসার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে গ্রাহকের একধরনের অবিশ্বাস বা অনাস্থার সম্পর্ক। সেটি কেন?
সিরাজুল ইসলাম: হ্যাঁ, এটা সত্য। এ ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে ভোক্তাদের একধরনের অবিশ্বাসের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। এর মূল কারণ ছিল সোনার খাদকে কেন্দ্র করে। গয়নায় সোনার চেয়ে খাদ ও ঝালাই বেশি দেওয়া হতো। কিন্তু গ্রাহকের তা যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ২০০৭ সালের পর থেকে এ অনাস্থা বা অবিশ্বাস অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ সোনার দোকানে কেডনিয়াম ব্যবস্থা বা বিশেষ যন্ত্র রয়েছে, সেখানে সোনার মান যাচাই করতে পারেন গ্রাহকেরা। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো এ ধরনের ব্যবস্থা চালু হয়নি। তাই হয়তো এখনো কিছু অবিশ্বাসের সম্পর্কটা রয়ে গেছে।