নিজেকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা রওশনের (ভাঙনের মুখে জাতীয় পার্টি)

0

jatio partyজাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় দলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আবারো ভাঙনের মুখে পড়েছে দলটি। এরশাদের আকস্মিক এ ঘোষণায় দলের একাংশে স্বস্তি ফিরলেও আরেক অংশের নেতাকর্মীরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। জাপার গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যানের কোনো পদ নেই বলে তারা এ ঘোষণাকে গঠনতন্ত্র বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। এ ঘটনায় দলের বিভক্তি নতুন রূপ পেয়েছে। নিজেকে জাতীয় পার্টির নতুন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন দশম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ।

আজ রাত ৮টা ১০ মিনিটে গুলশানের নিজ বাসায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সাথে এক বৈঠকে রওশন এরশাদ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।

জাপার রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত বর্তমান সরকারের তিন মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু ও মশিউর রহমান রাঙ্গা ও দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

জাপার গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যানের কোনো পদ না থাকলেও এরশাদের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে দলীয় প্রতিক্রিয়া জানাতে জাপার এমপি ও সিনিয়র নেতাদের নিয়ে যৌথসভা করা হয়েছে বলেও জানান বাবলু।

এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করার মধ্য দিয়ে নতুন বছরের শুরুতেই জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করেছেন। একই সাথে পার্টিতে নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করে নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের চাওয়াও পূরণ করলেন বলে অনেকেই মনে করছেন।

রংপুরে জাতীয় পার্টি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আজ থেকেই জিএম কাদের দলের কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া আমার অবর্তমানে দলের হালও ধরবেন তিনি।

যদিও এরশাদের এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন রওশন। এতোদিন তিনি নিজেকে দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে মনে আসছিলেন। এরশাদের এই ঘোষণায় তার এই ধারনায় ছন্দপতন ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

রওশন বিরোধীরা জানান, এরশাদের এই আকস্মিক ঘোষণা মুহূর্তেই কেন্দ্র থেকে দলের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় নতুন করে আশার আলো। ক্ষুদ্র একটি অংশ মনোক্ষুণ্ণ হলেও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন জাতীয় পার্টির বেশিরভাগ নেতা-কর্মী। তাদের মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলের ভেতরকার একটি পক্ষ এরশাদকে কোনঠাসা করে রেখেছিলো। জিএম কাদেরকে মূল নেতৃত্বে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে এরশাদকে ঘিরে থাকা বলয়ে শক্তি বাড়বে। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতেও নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হবে।

এ বিষযে দলটির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, এ ছাড়া আমার হাতে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। নিজের হাতে গড়া দলটি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে, জীবদ্দশায় তা মেনে নিতে পারি না। তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি এখন চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে। জাতীয় পার্টি আছে কি নেই, সেটা দেশের মানুষ জানে না। দেশের মানুষ লাঙলের নাম ভুলতে বসেছে। দলকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।

তিনি বলেন, আমার দলের তিনজন সংসদ সদস্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমরা বিরোধী দলে আছি, না সরকারি দলে আছি, দেশের মানুষ তা বুঝতে পারছেন না। এ অবস্থার অবসান এবং জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে হলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং আমাকে পদত্যাগ করতে হবে। দেশের মানুষও তেমনটাই আশা করে। মানুষ জাতীয় পার্টিকে শাক্তিশালী এবং কার্যকর রাজনৈতিকদলের ভুমিকায় দেখতে চায়। আগামী এপ্রিলে দলের যে ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন হবে সেখানে কো-চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করে তা অনুমোদন করে নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এ উদ্যোগের প্রশংসা করে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এরশাদ সাহেব সবদিকেই কথা বলেন। কোনটা তার মনের কথা আর কোনটা তার কথার কথা তা কেবল তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা চাই জাতীয় পার্টি সত্যিকারের এবং কার্যকর বিরোধীদলের ভুমিকা পালন করুক। দেরিতে হলেও এরশাদ সাহেব সেই সত্যটা উপলব্ধি করেছেন। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবছেন। এই শুভ চিন্তার জন্য তাকে ধন্যবাদ।

জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, তিনি (জিএম কাদের) অত্যন্ত সজ্জন, বিনয়ী এবং আন্তরিক। আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কেউ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেনি। যা একজন রাজনীতিবিদের জন্য বড় পাওয়া। যতোটুকু চিনি জানি জিএম কাদেরের রাজনৈতিক জ্ঞান, ধ্যান ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন, করারও চেষ্টা করেন। তাকে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে নিয়ে আসাটা দলের জন্য ভালো হবে।

হঠাৎ করেই জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এ পরিবর্তন নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে নানান নাটকীয়তার কারণে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলো দলটি। শেষ পর্যন্ত ৪০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি। বিরোধীদলীয় নেতা হন তার স্ত্রী ও দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ। পাশাপাশি মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেয় দলটি। পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ নিজে হন মন্ত্রি পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দুত। তিনজন নেতার স্থান হয় মন্ত্রিসভায়। একই সাথে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকায় দলটি নানামুখী সমালোচনার মুখে পড়ে। দেশে বিদেশে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই দলটির নেতাদের কাছে। টিআইবি জাতীয় পার্টির এই দ্বৈত ভুমিকার তীব্র সমালোচনা করে। নেতা-কর্মীদের মধ্যেও দলের এ ভুমিকায় সৃস্টি হয় চরম হতাশা। এরশাদ নিজেও এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার কথা মাঝে মধ্যেই তুলে ধরেন। জাতীয় পার্টির এ ভুমিকা নিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গেও বিরোধ দেখা দেয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দলের ভেতরে সুবিধাবাদীদের তৎপরতার কারণে জাতীয় নির্বাচনের পর হয়ে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিলেও সাফল্য পায়নি দলটি। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে দলের দৈন্যদশা আরো প্রকট আকারে ফুটে ওঠে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের নজিরবিহীন ভরাডুবি ঘটে। পৌরসভা এ নির্বাচনে মাত্র ৯৩টি পৌরসভায় প্রার্থী দিয়ে মাত্র একটিতে জয় পায় দলটি। দলের সাংগঠনিক অবস্থাও নাজুক। সারা দেশে মাত্র ২৭টি জেলায় দলটির কমিটি রয়েছে। বাকি জেলাগুলোতে কোনো কার্যকর কমিটি নেই।

এ বিষয়ে নতুন দায়িত্ব পাওয়া কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় জাতীয় পার্টি হারিয়ে যাচ্ছিলো। দলের অবস্থা নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছিলো। এ অবস্থার অবসানে আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতি কি- তা স্পষ্ট করতে হবে। জাতীয় পার্টির ভুমিকা কি হবে- তাও পরিস্কার করতে হবে। জাতীয় পার্টিকে কার্যকর বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে দলটিকে আবার মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। দলের গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যানের কোনো পদ নেই- তারপরেও আপনাকে এই পদে বসানো হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, চেয়ারম্যান তাঁর নির্বাহী ক্ষমতাবলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরবর্তী জাতীয় সম্মেলনে কাউন্সিলরদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যেই কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পার্টির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, রুহুল আমিন হাওলাদারকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব করার মধ্য দিয়ে এরশাদ কার্যত দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনারও আভাষ দিয়ে রাখলেন। কারণ সম্মেলনের সদস্য সচিব থাকেন সাধারণত দলের মহাসচিব। সেখানে মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বাদ রেখে হাওলাদারকে দায়িত্ব দেয়ার মধ্যেই মূল বার্তা নিহিত রয়েছে।

এ বিষয়ে সদস্য সচিবের সদ্য দায়িত্ব পাওয়ার রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আমি সবসময়ই এরশাদের দিকনির্দেশনায় কাজ করি, তিনি যখন যে দায়িত্ব দেন সেটি যথাযথভাবে পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। যদিও দলের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু নিজেও মহাসচিব পদে আর না থাকতে চাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এনিয়ে গত কিছুদিন ধরেই দলটির অভ্যন্তরে নানা কথাবার্তা চলছে।

যদিও পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পানিসম্পদ মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম বলেন, তিনি এটা করতে পারেন না। এটা করার আগে প্রেসিডিয়ামের বৈঠক করতে হবে। সেখানেই আলাপ-আলোচনা করে যা করার করতে হবে।

নিজেকে ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ ঘোষণা রওশনের
দশম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির নতুন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

আজ রাত ৮টা ১০ মিনিটে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সাথে এক বৈঠকে রওশন এরশাদ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।

প্রসঙ্গত, রওশন এরশাদ বর্তমানে দলটির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে আছেন। এর আগে, রংপুরের এক কর্মী সম্মেলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছোটভাই জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More