সত্যিই জিয়াউর রহমান আমৃত্যু একজন সৈনিক। সৈনিক হিসেবেই তিনি এই জাতির জীবনে সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন সময়ে আবির্ভূত হন। সৈনিক হিসেবেই তিনি সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেন। সৈনিক হিসেবেই তিনি শাহাদত বরণ করেন। সারা জীবন তিনি সৈনিক হয়ে রইলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই কাটালেন। তার জীবনে রণাঙ্গন বদলেছে। রণকৌশল পাল্টেছে। পাল্টেছে যুদ্ধাস্ত্রও। পাল্টায়নি শুধু তার সৈনিকজীবন। কোনো পরিবর্তন আসেনি বাংলাদেশ রাজনীতির ক্ষেত্রে তার সৈনিকসুলভ বলিষ্ঠ ভূমিকায়। এক অর্থে প্রত্যেকেই সৈনিক। জীবনটা যেন যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধ করেই সবাইকে টিকে থাকতে হয়। যা কিছু গৌরবের তা অর্জন করতে হয়। এ অর্থে জিয়াউর রহমান সৈনিক নন। তিনি সৈনিক দেশকে ভালো বেসে, দেশের জন্য অর্থপূর্ণ কিছু করতে উদগ্র আকাক্সক্ষার জন্য। তিনি সৈনিক একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী হিসেবে জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতিকে তাদের মধ্যে টেনে আনার পক্ষে দুর্লঙ্ঘ বাধা-বিপত্তি অপসারণের জন্য। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বে দেশপ্রেমিক সব রাষ্ট্রনায়কই সৈনিক। জাতীয় অগ্রগতি অর্জনের জন্য প্রতি পদে পদে তাকে লড়তে হয়। লড়তে হয় কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে, তা দেশেরও হয়, হয় বিদেশেরও। সর্বক্ষণ তাকে যুদ্ধকালীন সতর্কতার এক পরিবেশের মধ্যে থাকতে হয়। সব প্রতিবন্ধকতাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শত্রুর ওপর বিজয় অর্জনের কৌশল সদা তৈরি রাখতে হয়। লক্ষ্য অর্জনে সর্বাধিক স্বল্প ব্যয়ে যেন তা সম্ভব হয় সে সম্পর্কেও তিনি সদাজাগ্রত। এ অর্থেও জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক এবং বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তিনি ছিলেন এক সফল সৈনিক।
শ্রেষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধাদের একজন তিনি। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রধান সেনাপতি। জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী। তার যুদ্ধক্ষেত্র শুধু মুক্তিযুদ্ধের মহান ক্ষেত্রেই সীমিত নয়, তা সম্প্রসারিত ছিল মাঠে-ঘাটে, কৃষকদের দোরগোড়ায়, শ্রমিকের কারখানার প্রান্তে, দেশের তরুণদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার লক্ষ্যে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পল্লী উন্নয়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন চত্বরে। খ্যাতনামা নাট্যকার হেনরিক ইবসেন তার অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটকে (An Enemy of the people) লিখেছেন, ‘একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় একটি জাহাজের মতো। এই জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রত্যেককে তৈরি হওয়া উচিত’ (A community is like a ship; everyone ought to be prepared to take the helm.)। সত্যিই তো, পরিচালনার দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্রীয় জাহাজের প্রত্যেক যাত্রীকেই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রত্যেককেই নাবিকের ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হতে হয়। এই তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মহান শিক্ষা। অংশগ্রহণকারী নাগরিক (তথা পারটিসিপেন্ট সিটিজেন) হিসেবে প্রত্যেককে গড়ে উঠতে হবে। তা না হলে, এ ব্যবস্থা সার্থক হবে না। স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য অর্থপূর্ণ হবে না। গণ-অধিকার হারাবে তার মর্মবাণী। মুক্তিযুদ্ধের অনলকুণ্ড থেকে প্রাণ পাওয়া বাংলাদেশে জনগণের জীবনে আসবে না পরিবর্তনের কোনো ছাপ। লাগবে না অগ্রগতির বিন্দুমাত্র ছোপ। কিন্তু এই পরিবর্তন তো আপনা-আপনি আসবে না। অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বে গণ-অধিকারের প্রত্যয় তো এমনিতেই আসেনি। সব ক্ষেত্রে এ জন্য প্রয়োজন হয়েছে একজন যুগদর্শীর। একজন জননেতার। একজন সৈনিকের বাংলাদেশে এই যুগদর্শী হলেন জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান।
তারই সার্থক নেতৃত্বের পরশমণির স্পর্শ গ্রাম-বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে এই পরিবর্তনের মৃদু তরঙ্গ। নতুনভাবে জনগণকে ভাবিয়ে তোলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে। তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে। এর মূল নিহিত জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির অভ্যন্তরে। গ্রাম-বাংলাকেই তিনি চিহ্নিত করেছিলেন তার মূল কর্মক্ষেত্ররূপে। লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন যুগ যুগ ধরে উপেক্ষিত গ্রামীণ জনসাধারণকে। সূচনা করেছিলেন শেকড়স্পর্শী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের। তিনি সঠিকভাবে অনুধাবন করেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সনাতন জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত মানুষকে নতুন পৃথিবীতে টেনে আনতে হলে শাসনব্যবস্থায় তাদের সক্রিয় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি পল্লী অঞ্চলকে প্রশাসনের প্রধান লক্ষ্যে রূপান্তরিত করেন। এ দেশের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম গ্রামবাসীর নিজস্ব সরকার- গ্রামসরকার সৃষ্টি করেন যেখানে নিজেদের মতো করে গ্রামপর্যায়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তারা করতে পারেন। গ্রামপর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম এ দেশের গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন। গ্রামাঞ্চলে যুবশক্তিকে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজে লাগানোর জন্য যুব-কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থা করেন। পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পল্লী এলাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের ব্যবস্থা করেন। এভাবেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গ্রামীণ সেচব্যবস্থা, মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য এবং বয়স্ক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। ১৯৭৬-৭৭ সালে গৃহীত পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-১-এর মাধ্যমে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ের উন্নয়ন কর্মসূচি, ১৯৭৭-৭৯ সালে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প-২-এর মাধ্যমে বৃহত্তর পাবনার ৭২ কোটি টাকা কর্মসূচি এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে নোয়াখালী সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির সাফল্য এ ক্ষেত্রে নতুন দিগদর্শন। ১৯৭৮ সালে গৃহীত দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্য চিহ্নিত হয় সে দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল উন্নয়নের হার বাড়ানো, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে পরনির্ভরশীলতা কমানো, সম্পদের সুষম বণ্টন, জনসংখ্যা বাড়ার হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, নিরক্ষরতা দূর করা এবং রফতানি আয় বাড়ানোর মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন। দেশকে স্বনির্ভর ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়নে কৃষকদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই স্বল্পমেয়াদি ঋণদানের ব্যবস্থা চালু করেন। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। শুধু প্রকল্প প্রণয়ন এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার উদ্যোগকে সীমিত না রেখে পল্লী অঞ্চলের মানুষের অবস্থা সরাসরি দেখার জন্য তিনি গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে ছুটে গেছেন। কথা বলেছেন কৃষকদের সাথে, জেলে-মুটে মজুরদের সাথে। প্রত্যেকের মনে জাগ্রত করেছেন একধরনের অদম্য স্পৃহা। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নতুন উন্মাদনা। এমনি এক ঘটনার বিবরণ দিয়ে এ কে এম শামসুল বারী মিয়া মোহন লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া এক সভাশেষে ফেরার সময় হঠাৎ ওই কৃষকের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েন। বাড়ির মহিলাকে বলেন, ‘আমাকে বসতে দিন’। মোড়ায় বসে তিনি বলেন, ‘মা আমাকে কি খেতে দেবেন?’ মহিলা তো আর তাকে চেনে না। তাই বলল, ‘কী খাবেন আপনি?’ তিনি বললেন, ‘পেঁপে খাবো।’ মহিলা বলল, ‘পেঁপে তো নেই আমাদের।’ তিনি বলেন, ‘তবে কী আছে? কলা, লেবু ডাব?’ মহিলাটি বলল, ‘তা-ও নেই।’ ‘তবে দুধ আছে তো? তাই দিন’। জিয়া বলেন, ‘একটা ছাগল তো পালতে পারেন।
আর লেবুগাছ, কলাগাছ, পেঁপেগাছ লাগানো তো সহজ। এ জন্য বেশি জায়গাও লাগে না। এসব লাগাবেন, আমি আবার আসব মেহমান হয়ে, কেমন?’ এরই মধ্যে বাড়ির মালিক এবং অন্য সব লোক এসে হাজির হলো। লোকটি বলেছিল, ‘বাবা আমি লেবুগাছ, পেঁপেগাছ, কলাগাছ লাগিয়ে, ছাগল কিনে আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’ এভাবে জিয়াউর রহমান গ্রাম-বাংলায় সৃষ্টি করেছিলেন জাগরণের নতুন স্পন্দন। খাল কাটা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গ্রাম-বাংলার লাখো মানুষকে তিনি সম্পৃক্ত করেছিলেন সামগ্রিক কার্যকলাপে। নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ জনসাধারণের মধ্যে জাগিয়েছিলেন নতুনভাবে ভাগ্য গড়ার প্রত্যাশা। পরিকল্পিত পরিবারব্যবস্থার শুভসূচনা করে বলিষ্ঠ জীবনবোধে সংযোজন করেন নতুন অধ্যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপচয়প্রবণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজতন্ত্রকে পাল্টে, বেসরকারি উদ্যোগকে প্রাণবন্ত করে, বিশেষ করে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়ে এবং রফতানি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে যে দিকনির্দেশনা দান করেন আজ তা বিকশিত হয়েছে ফুলে-ফলে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হলো? কিভাবে একজন পেশাদার সৈনিক জাতি গঠনের সৈনিকে রূপান্তরিত হলেন? এমন রূপান্তরের কারণের দিকে না তাকিয়ে শুধু ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি দিলেও এমন দৃষ্টান্ত মেলে অনেক। ‘ইউরোপের অসুস্থ মানুষ।’ (সিক-মেন অব ইউরোপ) রূপে নিন্দিত, নিগৃহীত এবং পদদলিত তুরস্কের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল কামাল আতাতুর্কের ভগ্নস্তূপ থেকে মিসরের উত্থানের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল গামাল নাসেরের। চতুর্থ রিপাবলিকের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ফ্রান্সকে আলোয় টেনে আনার জন্য জেনারেল দ্য গলের। তার প্রয়োজনীয়তার কথা ফরাসি জাতি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে। লিবিয়াকে আধুনিকতার আলোয় আনার কৃতিত্ব কর্নেল গাদ্দাফির একার। ঘানা যে আজ বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে পরিচিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে এন ক্রুমার অবদান। জিয়ার সাথে এসব নেতার আত্মিক সম্পর্ক। সবাই ছিলেন প্রথম শ্রেণীর দেশপ্রেমিক। সবাই ছিলেন এক নম্বরের জাতীয়তাবাদী। সবারই চিন্তাভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে জাতীয় শ্রীবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, জাতীয় সংস্কৃতির অনস্বীকার্য স্বাতন্ত্র্য, জাতীয় রাজনীতির স্বাধীনচেতা বৈশিষ্ট্য। সবাই চেয়েছেন জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সমগ্র জাতির, বিশেষ করে পল্লীবাসীর, কৃষক-শ্রমিক ও জনসমষ্টির অবহেলিতদের অংশ নেয়া। সবারই চোখে একই আলো- ‘আমার দেশ, আমার জাতি কোনো দিন কারো কাছে মাথা নত করবে না। ভিক্ষার হাত কারো কাছে প্রসারিত করবে না।’ প্রত্যেকেই চেয়েছেন, রাজনীতি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অথবা সংগ্রামে পরিণত না হয়ে হোক জনকল্যাণ অর্জনের সুষ্ঠু মাধ্যম। প্রত্যেকে তাই এখনো বেঁচে রয়েছে জাতীয় চেতনায়, জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের অন্যতম হয়ে। কে তাদের ভুলতে পারে? কার সাধ্য ভোলে জিয়াকে? প্রত্যেকে চেয়েছেন জাতিকে স্বয়ম্ভর করে গড়ে তুলতে যেন নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা ভুলে গিয়ে অন্যের ওপর নির্ভর করতে না হয়। হেনরিক ইবসেনের কথা, এসব জাতীয় সৈনিক বিশ্বাস করতেন যে, ‘যে সংসার ঋণের ওপর নির্ভরশীল সেখানে থাকতে পারে না কোনো স্বাধীনতা, থাকে না কোনো সৌন্দর্য (There can be no freedom or beauty about a home life that depends on borrowing or debt!- A Doll’s House, Act-I’).