অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারির পর সরকার তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারে উদ্যোগ নিয়েছে। তারপরও যুক্তরাজ্য সরকার সম্প্রতি ঢাকা থেকে সরাসরি সেই দেশে উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাজ্যে সবজি ও ফল রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতেও মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ইমেজ সংকটের কারণে। এ অবস্থা চলতে থাকলে জানে বাঁচা কঠিন বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাই এ সমস্যা সমাধান করতে সরকারের কাছে তারা আহ্বান জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী মানবকণ্ঠকে বলেন, নিরাপত্তার অজুহাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্য সরকার সরাসরি কার্গো বিমান চলাচলে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে রফতানিতে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়বে। কারণ ওই দেশে তৈরি পোশাক, সবজি, চিপস, চিংড়িসহ অনেক পণ্য রফতানি হয়ে থাকে। যেগুলো বন্ধের পথে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাপকভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে। এতে আমাদের জানে বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার বাজার ছোট, তাই তাদের নিষেধাজ্ঞায় খুব একটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। তবে যুক্তরাজ্য আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এ দেশ থেকে অর্ধশতাধিক সবজি, লেবু, আমড়া, চালতে, আম, কাঁঠালসহ নানা জাতের মৌসুমি ফলও রফতানি হয়। এসব ফল ও সবজির মূলত প্রবাসী বাঙালিরাই বড় ক্রেতা। তাই সরকারকে খুব দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে এ সমস্যা সমাধানের। তা না হলে আমাদের রফতানি চ্যালেঞ্জের মুখে পডবে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, অস্ট্রেলিয়ার নিষেধাজ্ঞার পর ঢাকায় নিযুক্ত সে দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিজিএমইএতে আমরা বৈঠক করি। তিনি সমস্যা সমাধানে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এবার যুক্তরাজ্য সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কিছু পরিমাণে রফতানি হয়েছে। শুক্রবার থেকে সবজি ও ফল রফতানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী হলে এ বাজার হারাতে হবে। তবে বাজার ধরে রাখার চেষ্টা চলছে। বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের ট্রানজিট পয়েন্টে স্ক্যান করে যুক্তরাজ্যে পাঠানো যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, দেশটির ক্রেতাদের সঙ্গে এক বছরের চুক্তি রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এখন আর পণ্য পাঠানো না গেলে ক্রেতারা প্রতিযোগী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে চলে যাবে। দেশটির ক্রেতাদের কাছে প্রায় শতকোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে, তা আদায় করা দূরূহ হবে। এ নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে বছরে প্রায় সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার বিদেশি বাজার হারাবে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য বিকল্প পথের সুযোগ থাকলেও আকাশপথ বন্ধ হওয়ায় সবজি ও ফল রফতানি সংকটে পড়বে বলে জানান তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, কার্গো বিমানে অস্ট্রেলিয়ায় নিষেধাজ্ঞার প্রভাব তেমন আমাদের রফতানিতে না পড়লেও যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা ব্যাপকভাবে পড়বে। কারণ ১০ শতাংশের বেশি রফতানি হয়। তাই সরকারের উচিত দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্র মতে, সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ায় এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়া সরকারের অবকাঠামো ও আঞ্চলিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন নিরাপত্তা বিভাগ নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ থেকে বিমানে পণ্য পরিবহনে কড়াকড়ি আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তার মান সন্তোষজনক নয়। সরকার তা আমলে নিয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে জরুরি সভার আয়োজন করে। সভায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমদ সিদ্দিকী উল্লেখ করেন, জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যোগাযোগ বজায় রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। তা মোকাবিলা করতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। এরপরই বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। করণীয় ঠিক করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে জরুরি সভার আয়োজন করে উদ্ভূত পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দিতে ‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসমূহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে জরুরি সরঞ্জামাদি সরবরাহ ও সংস্থাপন’ নামক একটি প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়।
তাতে বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীর দেহ, ব্যাগ অথবা কার্গোর মাধ্যমে বোমা, বিস্ফোরক অথবা অন্য কোনো বিপজ্জনক দ্রব্য, বস্তু বা পদার্থ যাতে বহন করা না যায় সে জন্য স্ক্রিনিংয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ বিশেষ ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় ওই প্রকল্পটির অনুমোদন দেন। এতে উন্নত প্রযুক্তির স্ক্যানিং মেশিন ব্যবহার করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ব্যাপকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপার জড়িত থাকায় দ্রুত গতিতে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু ওই দিনই অর্থাৎ মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য সরকার আবার কার্গো বিমানে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তা নিয়ে দেশে ব্যাপকভাবে হইচই পড়েছে। এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি মনে করি, এটি সাময়িক। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। যুক্তরাজ্য শিগগিরই কার্গো চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।