রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় অবস্থিত ৬৫ বছরের পুরোনো মগবাজার গার্লস হাইস্কুলের নাম বদল করা হয়েছে। এখন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মায়ের নামে স্কুলটির নামকরণ করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম ‘গাজী সামসুন নেসা গার্লস হাইস্কুল’। স্কুলটির পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি পাটমন্ত্রীর ছেলে গাজী গোলাম আসরিয়া। তিনি গাজী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
নতুন নামকরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্কুলের পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি এস এম সাইফুজ্জামান। তাঁর অভিযোগ, ইস্পাহানি গ্রুপের দানে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন এই স্কুলের নাম ‘কায়দাকানুন’ করে পরিবর্তন করা হয়েছে।
অবশ্য স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোবারেকা খালেদ বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাতে উন্নয়ন হয়, সে জন্য তাঁরা সবাই মিলেই নতুন এই নাম চেয়েছেন।
সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নতুন নামকরণের বিষয়ে আবেদন করা হয়েছিল।…তার আলোকেই নিয়ম মেনে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে
তপন কুমার সরকার, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
আর ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেছেন, নিয়মকানুন মেনেই স্কুলটির নাম বদল করা হয়েছে।
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি রমনা থানা এলাকার ৫২ সিদ্ধেশ্বরীতে অবস্থিত। বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ক্যাম্পাসে পাশে স্কুলটির অবস্থান। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন এমপিওভুক্ত। এর মানে স্কুলের শিক্ষকেরা সরকার থেকে বেতনের মূল অংশের পুরোটাই পান। পাশাপাশি পান কিছু ভাতা। স্কুলের শিক্ষকসংখ্যা ১৬। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন এমপিওভুক্ত। আর ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৩০০।
স্কুল ও পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এবং বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক)। স্কুলের নাম পরিবর্তনের আলোচনা তখনই শুরু হয়েছিল। তবে তখন এই আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। পরে পরিচালনা কমিটিতে কিছুদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ঢাকার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বেনজীর আহম্মেদ। তাঁর পরে সভাপতি হন জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি এস এম সাইফুজ্জামান। তিনি ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এরপর থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন গাজী গোলাম আসরিয়া।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোবারেকা খালেদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। গত সোমবার নতুন নামের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আদেশ জারি করে শিক্ষা বোর্ড।
স্কুল-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোবারেকা খালেদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। আবেদনের পাঁচ দিনের মাথায় ১২ ডিসেম্বর স্কুলটি পরিদর্শন করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা। তাঁরা চলতি বছরের ২ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। ১৩ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘গাজী সামসুন নেসা গার্লস হাইস্কুল’ করতে সম্মতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। গত সোমবার নতুন নামের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আদেশ জারি করে শিক্ষা বোর্ড।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নতুন নামকরণের বিষয়ে আবেদন করা হয়েছিল। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ডের পরিদর্শন প্রতিবেদনও ইতিবাচক এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন নামকরণের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। তার আলোকেই নিয়ম মেনে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণের ক্ষেত্রে আগ্রহী ব্যক্তিকে স্কুলের তহবিলে ৩০ লাখ টাকা জমা দিতে হয়। তবে এ জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত (রেজল্যুশন) নিতে হয়। আশপাশের এলাকার মানুষের মতামত নিতে হয়। এসব করে নাম বদলের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন দিতে হয়। তারপর আনুষঙ্গিক কাজগুলো করা হয়।
স্কুল ও পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এবং বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক)। স্কুলের নাম পরিবর্তনের আলোচনা তখনই শুরু হয়েছিল।
স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি সাইফুজ্জামান অভিযোগ করে বলেন, ‘আইনে কী আছে, সেটি বড় কথা নয়। এই স্কুলের নাম বদলের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এটি একটি প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ইস্পাহানি গ্রুপ। স্কুল প্রতিষ্ঠায় তারাই সহায়-সম্পত্তি দান করেছিল। অত্যাবশ্যক কোনো কারণ থাকলে স্কুলের নাম পরিবর্তন হতেই পারে। কিন্তু এখানে সেই কারণটা কী, তা বোধগম্য নয়। পরিবারের কোনো সদস্যের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে চাইলে যে কেউ তা করতেই পারেন। একটা কেন, ১০টা করলেও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আরেকজনের দানে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের নাম কায়দাকানুন করে কেন পরিবর্তন করা হলো, সেটাই প্রশ্ন।’
গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, তখনো নতুন নামের ফলক লাগানো হয়নি। আগের নামেই স্কুলের ফলক আছে। স্কুলের ভেতরে গিয়ে কথা হয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোবারেকা খালেদের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি প্রথমে নাম বদলের বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কীভাবে জানলেন?’
পরে মোবারেকা খালেদ বলেন, নাম বদলের বিষয়টি আনন্দের। কারণ, স্কুলটির অবস্থান মগবাজারে না। তাই মগবাজার গার্লস হাইস্কুল বললে অনেকে মগবাজারে চলে যান। তা ছাড়া একসময় স্কুলটির খুব সুনাম ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সেরা স্কুলের পুরস্কারও পেয়েছিল। কিন্তু পরে সুনাম কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তাই তাঁরা চান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আমূল পরিবর্তন হোক। এসব কারণে তাঁরা নাম পরিবর্তন চেয়েছেন। পরিচালনার কমিটির বর্তমান সভাপতি স্কুলের উন্নয়নে অনেক কিছু করছেন। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে স্কুলের হলরুম সাজিয়ে দেওয়াসহ অনেক কাজ করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁরা মনে করছেন, তাঁরা (সভাপতির পরিবার) হাল ধরলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
আইনে কী আছে, সেটি বড় কথা নয়। এই স্কুলের নাম বদলের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়
সাইফুজ্জামান, স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি
স্কুলটির আশপাশে কয়েকটি ব্যানার-ফেস্টুন–পোস্টার দেখা গেল। এতে পরিচালনার কমিটির বর্তমান সভাপতির ছবি দিয়ে লেখা আছে, ‘জনাব গাজী গোলাম আসরিয়া স্যারের ব্যক্তিগত অর্থায়নে সার্বিক উন্নয়নমূলক সংস্কারকাজ চলছে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে গতকাল মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে মন্ত্রণালয়ে তাঁর দপ্তরে গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা কর হয়। তবে তাঁর দপ্তর থেকে জানানো হয়, তিনি বেরিয়ে গেছেন।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে
স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের কক্ষে টানানো নামফলকে ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১১ জন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের তথ্য রয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাতজনই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। সর্বশেষ ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে স্কুলটি। এই সময়ে মোবারেকা খালেদসহ তিনজন বিভিন্ন মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্কুল সূত্রে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার কারণেই মূলত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চলছে। ২০১৫ সালে স্কুলটির তৎকালীন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনাস্থার জেরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন প্রধান শিক্ষকের বয়স ৬০ বছর হয়ে যাওয়ায় নিয়মানুযায়ী তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্কুলের পরিচালনা কমিটি বিধিবহির্ভূতভাবে তাঁর চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া স্কুলের পরিচালনা কমিটি নিয়ে বিরোধ ২০১৮ সালে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিধিবিধান অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে নামে আছে, সেই নামে থাকাই যৌক্তিক। নাম পরিবর্তন না করে কেউ চাইলে নতুন প্রতিষ্ঠান করতে পারেন। আর তিনি যত দূর জানেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেই মূলত স্কুলটিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সমস্যা চলছে। তবে এই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। কারণ, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারেন না।