নিত্যপণ্যে দিশেহারা মানুষ, এক পাঙ্গাস কিনে ৫ ভাগ

0

শহরের বৃহত্তম দ্বিগু বাবুর বাজার। হাতে সবজির ব্যাগ নিয়ে মুরগিপট্টিতে প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে এদিক ওদিক হাঁটছেন এক মার্জিত ভদ্রলোক। বিক্রেতাদের পাশাপাশি কয়েকজন ক্রেতাও মনে করছিলেন তিনি হয়তো প্রশাসনের বাজার মনিটরিংয়ের সদস্য। উৎসুক এক ক্রেতা তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানালেন তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা।

চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মুরগি কিনতে এসেছিলাম, সাহসে কুলোয়নি তাই চলে যাচ্ছি।

নগরীর বাবুরাইল এলাকার বউবাজার। ৩ নারী গার্মেন্টকর্মী মাছের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অনেকক্ষণ। সেখানে রুই, কাতলা আর পাঙ্গাস মাছের দরদাম দেখার পর ২৫০ টাকা দিয়ে মাত্র আধা কেজি মলাই মাছ কিনলেন, সঙ্গে ২০ টাকার শাক। যাওয়ার সময় মাংসের দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ।

ফতুল্লার কাঠেরপুলের অস্থায়ী বাজার। পাঁচজন দিনমজুর মিলে কিনলেন ২৮০ টাকা কেজি দরে ৩ কেজি ওজনের পাঙ্গাস মাছ। কিনে সেটি পাঁচ ভাগে ভাগ করে নিচ্ছেন। তাদের সবাই পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন এক এলাকাতেই।

মাংসের দোকানে ৭৫০ কেজি দরে আধা কেজি গরুর মাংস, এক কেজি আলু আর পলিথিন ব্যাগের তলানিতে পড়ে থাকা গুটিকয়েক পেঁয়াজ নিয়ে ভাঙতি টাকাগুলো কয়েকবার গুনছিলেন একজন মধ্যবয়সি। জানা গেল স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম তিনি। মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাঁচজনের সংসার।

এমন চিত্র প্রতিদিনকার হাজারও সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষের কাছে ‘বাজার’ যেন কোনো যুদ্ধ ক্ষেত্র, যেখানে সাধারণ মানুষের দিশেহারা পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত নিট শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা প্রায় ১৫ লাখ মানুষের পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন শিল্প সেক্টরে রয়েছেন আরও প্রায় ১০ লাখ স্থানীয় ও অন্য জেলার মানুষ। যাদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের। নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে চাপা ক্ষোভে ফুঁসছেন শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জের মানুষ। কেউ মুখে কিছু না বললেও চাপা ক্ষোভ ফুটে উঠছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির চোখে।

চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা-ময়দা, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের সঙ্গে স্বস্তি নেই সবজির বাজারেও। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, নদীর মাছ, মুরগি কিংবা গরু বা খাসির মাংস এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কাছে সোনার হরিণের মতই। যে ডিম, চাষের মাছ আর বয়লার মুরগি ছিল তাদের ভরসা সেখানেও দাম বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ডিম ও বয়লার মুরগি কিনতেও দশবার ভাবতে হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের।

সরেজমিন শহরের পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে ঘুরে এবং বিভিন্ন শ্রমঘন এলাকায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুর্দশার কথা। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত রমজান মাস এলেই দেশে চাহিদা বাড়ে বিভিন্ন প্রকার ডাল এবং বুটের। বাজারে প্রকার ভেদে মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫, ১০০ ও ৯৫ টাকায়। খেসারি ডাল কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। ছোলা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। বুট কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। ডাবলি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়।

মূলত এগুলোর সবটির দামই এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। রমজান আসার দু-দিন আগে এক লাফে বিভিন্ন বাজারে কাঁচা মরিচের দাম কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে। ৬০ টাকার কাঁচা মরিচ এখন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বেগুনসহ অন্যান্য সবজির দামও এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে।

রমজান শুরুর আগেই কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়। আর ছাগলের মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায়।

শহরের দ্বিগু বাবুর বাজারের ক্রেতা ব্যাংক কর্মকর্তা চৌধুরী গোলাম জিলানী বলেন, বাজার মনিটরিংয়ে আমূল পরিবর্তন আনা উচিত। ঢাকঢোল পিটিয়ে, লোকজন সঙ্গে নিয়ে গেলে বোঝাই যায় প্রশাসনের লোকজন এসেছে। বাজার মনিটরিংয়ে যাওয়ার এই রীতি চেঞ্জ করা উচিত। ছদ্মবেশের প্রয়োজন নেই, মনিটরিং কমিটির কর্তা বা সদস্যরা সাধারণ ক্রেতার মতো গেলেই প্রকৃত চিত্রের বন্যা বয়ে যাবে। তবে বড় বা ছোট ছোট বাজারের আগে যেতে হবে পাইকারি মোকামে, সেটাও ক্রেতা সেজে। যে কোনো সময় মনিটরিং কমিটির লোক বাজারে আসতে পারে, এমন ভয় ঢুকলেই বাজার স্থিতিশীল থাকবে।

গণমাধ্যম কর্মী আবির শিকদার জানান, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির জন্য শুধু আন্তর্জাতিক বাজার আর বিদেশের যুদ্ধকে দায়ী করেন কেউ কেউ। কিন্তু এই কারসাজির নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকায় আছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আর কিছু কালোবাজারি, যাদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ। এজন্য সরকারের উচিত বাজার নিয়ন্ত্রণে অধিক সংখ্যায় মনিটরিং সেল গঠন করা।

অসংখ্য গার্মেন্টস শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে তারা ক্ষোভ জানিয়ে বললেন, ‘কারে কি কমু? বাড়ি ভাড়া, খাওন খরচ, গ্রামের বাড়িতে থাকা বয়স্ক বাবা-মায়ের খরচ, অফিসে আসা-যাওয়া খরচ কোন খরচটা বাদ দিমু। মন্ত্রী এমপিরা তো আগেই কইছে একদিনের তেলে দুই দিন খামু। এক বেলার ভাত দুই বেলা খামু। কিন্তু শুধু ডাল-ভাত যে তিনবেলা খামু সেটাই তো কষ্টকর।

বেশ কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সারা দিনে রিকশা চালিয়ে গ্যারেজে জমার টাকা দিয়ে দুইশ টাকার বেশি হয় না। এই টাকায় পরিবার নিয়ে খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা কেমনে সম্ভব। যাত্রীদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া যায় না; কারণ তারাও তো একই পরিস্থিতির শিকার।

জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ জানিয়েছেন, রমজানে দ্রব্যমূল্যের বাজার দর ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে স্থিতিশীল রাখতে জেলা প্রশাসন থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে, প্রতিদিন এই মনিটরিং চলবে। কোথাও অস্বাভাবিক দাম বা মজুতদারি পাওয়া গেলে কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনা হবে।

উৎসঃ   যুগান্তর
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More