নারায়ণগঞ্জ থেকে বিশেষ: একটি রাস্তা নিয়ে বিরোধের জের ধরেই নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার পরিকল্পনাকারী আরেক সিটি কাউন্সিলর নূর হোসেন। ‘র্যাব পরিচয়’ দিয়েই সাতজনকে তুলে নেয় হত্যাকারী চক্র।
হত্যাকারীদের টার্গেট ছিল নজরুল ইসলাম একাই। তবে ঘটনার সাক্ষী হওয়ার কারণে বাকিদেরও একই পরিণতি হয়েছে। অবশ্য হত্যার আগে জীবন নিয়ে শঙ্কার কারণে পালিয়ে বেরিয়েছেন নজরুল। নারায়ণগঞ্জে অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়। লাশগুলো যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেখানেই ফেলা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার তদন্ত এখন অপহরণকারীদের পরিচয় শনাক্তকরণেই থমকে আছে। নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের ওপর মূল অভিযোগ উঠলেও অপহরণ ও কিলিং মিশন কারা চালিয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় তদন্তকারীরা।
জানা গেছে, নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন নূর হোসেন। এরপর থেকে দখল, দলীয় পদ এবং সর্বশেষ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নির্বাচিত হওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। তবে একটি রাস্তার কাজ নিয়েই বিরোধের সূত্র ধরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করছেন নিহতের স্বজনরা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মৌচাক এলাকা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধুরীপাড়া বাজার হয়ে মিজমিজি পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়নের কাজ নিয়ে সম্প্রতি নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের বড় ধরনের বিরোধ দেখা দেয়। তানভীর মজুমদার নামের এক ঠিকাদার গত ফেব্রুয়ারিতে এ সড়কটির উন্নয়নের কাজ শুরু করেন। নিজ এলাকায় কাজ হওয়ার কারণে ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে কাজটি তদারকির দায়িত্ব দেন সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। রাস্তাটি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে চৌধুরীপাড়া এলাকায় মোবারক হোসেন এবং জালাল নামে দুই ব্যক্তির বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধাগ্রস্ত হন ঠিকাদার। মোবারক হোসেন নামে ওই ব্যক্তির চালের আড়তের শাটার থেকে কিছু অংশ পেছনে সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানানো হয়।
জালাল দাবি করেন, মোবারক জায়গা ছেড়ে দিলে তিনি ছাড়বেন। এ নিয়ে কাউন্সিলর নজরুল দুইজনের সঙ্গে কথা বলেন। এদিকে মোবারক নামের ওই ব্যবসায়ী ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের খালাতো বোনের জামাতা। তিনি নূর হোসেনকে বিষয়টি জানালে এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুই কাউন্সিলরের উপস্থিতে চৌধুরীপাড়া এলাকায় শালিস-বৈঠক হয়।
স্থানীয়রা জানান, ওই বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর নূর হোসেন ও নজরুল ইসলামের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। পরে নূর হোসেন খবর দিলে শিমরাইল এলাকা থেকে ১০/১২ মাইক্রোবাসে করে লোকজন এসে ওই এলাকায় হামলা চালায়। তারা চৌধুরীপাড়ার ২০-২৫টি দোকান ভাঙচুর করে। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে গুলি ও বোমা ফাটায়। এ সময় নজরুল ও তার সহযোগীরা ভয়ে এলাকা ছাড়েন।
ওই হামলার নেতৃত্ব দেন নূর হোসেন, ইয়াছিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন, শাহ জালাল বাদল, ইকবাল হোসেনসহ কয়েকজন। এ ঘটনার পর নূর হোসেনের পক্ষই উল্টো নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মোবারক হোসেন বাদি হয়ে নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীসহ ১৬ জনকে আসামি করে এ মামলাটি করেন। এরপর এলাকায় ফিরতে পারেননি নজরুল।
রাস্তার কাজের ঠিকাদার তানভীর মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘৪২৮ মিটারের (প্রায় আধা কিলোমিটার) এ রাস্তাটি উন্নয়নের কাজে বাধা দিয়েছিল একটি গ্রুপ। সেখানে নজরুল ইসলাম প্রতিবাদ করেছিলেন। এ নিয়ে তাকে এলাকা ছাড়া করা হয়।’
থমকে আছে তদন্ত:
প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজন অপহরণ করে হত্যার পর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দেশব্যপী তোলপাড় শুরু হলেও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে এর কোনো প্রভাবই পড়েনি। ঘটনার ছয়দিন পার হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার করা যায়নি। আইনের আওতায় আনা যায়নি সন্দেহভাজন কাউকে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলার অভিযোগ ধরে তদন্ত হলেও অপরণকারীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে তদন্তটি এক রকম থমকে আছে। এখন হত্যাকারীরা কারা তা খুঁজে বের করার আগে তদন্তে বের করতে হবে অপহরণকারী কারা। তবে এ বিষয়ে তদন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছুই করা যাচ্ছে না বলেও দাবি করে এই সূত্র।
এদিকে অপহৃত দুই জনের গাড়ি, লাশের সঙ্গে পাওয়া আলামত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের অভিযোগের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে বলে দাবি করছেন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার গঠিত পুলিশের ১২ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা কথা বলবেন।’
নারায়ণগঞ্জের নতুন পুলিশ সুপার খন্দকার ড. মুঈদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এ মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। অগ্রগতি হলে জানানো হবে।’
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ:
নিহত নজরুল ইসলামের স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের দাবি- নূর হোসেন র্যাব বা অন্য কোনো স্বশস্ত্র পক্ষের সহায়তা নিয়ে নজরুলসহ সাতজনকে হত্যা করেছে। নূর হোসেন নিয়মিতভাবে প্রশাসনসহ বিভিন্ন পক্ষে মাসোয়ারা দেয় এবং নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালীরা নূর হোসেনের পক্ষে ছিল বলেও দাবি তাদের। তবে হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নূর হোসেনের সহযোগীরা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলার এজাহারে নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হলেন- নূর হোসেন, হাজী ইয়াছিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন ও ইকবাল হোসেন।
এরমধ্যে হাসমত আলী হাসু সম্পর্কে নজরুলের চাচা শ্বশুর। সিএমবির বড় মাপের ঠিকাদার হাসুর সঙ্গে নূর হোসেনের সর্ম্পক গড়ে উঠে মহাসড়কে কাজের জন্য নেটওয়ার্ক বিস্তারের মাধ্যমে। অপহরণ ও হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি হাজী ইয়াছিন মিয়াও নজরুলের প্রতিবেশী। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণেই তিনি নজরুলের বিরোধী পক্ষের সঙ্গে হাত মেলান। নজরুল অপহৃত হওয়ার পরদিন অর্থাৎ গত ২৮ এপ্রিল স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার কথা বলে সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন তিনি। লাশ উদ্ধারের পর গত বুধবার রাতে শিমরাইল এলাকায় তার পেট্রোল পাম্প শ্যামস ফিলিং স্টেশনেও আগুন দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। এরপর বৃহস্পতিবার মিজমিজি এলাকায় তার বাসার সামনে তৈরি করা ক্লাবে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
সূত্র জানায়, নূর হোসেনের অন্যতম সহযোগী মতিন মাস্টারের ছেলে আরিফুল হক হাসান, কুটপাড়ার সেলিম, আইলপাড়ার মতি, শাহজাহান ওরফে বরিশাল্লা শাহজাহান, আলী আহমেদ এবং সানাউল্লাহ সানা। এদের মধ্যে নূর হোসেন, তার ভাই আলী, সানা ও শাহজাহানের শর্টগানের লাইসেন্স আছে।
নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি সাংবাদিকদের বলেন, ‘র্যাবের মতো লোক আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। আমি নিশ্চিত এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা নূর হোসেনেরই। নূর হোসেন একটি গ্রুপকে দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’ তবে কারা হত্যা করেছে তা প্রশাসনই বের করতে পারবে বলে মন্তব্য করেন স্বজনরা।
শ্বাসরোধেই হত্যা:
অপহরণের হত্যা করা সাতজনের লাশেরই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে। সেখানকার আবাসিক মেডিকেল অফিসার আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখনো ময়না তদন্তের প্রতিবেদন সম্পন্ন হয়নি। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে যা দেখেছি, তাতে সাতজনকেই শ্বাসরোধ করে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। এরমধ্যে নজরুলসহ ছয়জনের মাথায় সামান্য আঘাতের চিহ্ন আছে। হত্যার পর তাদের পেট চিরে পানিতে ফেলা হয়েছে।’ লাশ উদ্ধারের ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের পেটে গুলির মতো চিহ্ন দেখা গেছে। তবে পরে জানা গেছে এটি তার অস্ত্রপচারের দাগ।’
এদিকে এলাকাবাসী জানান, গত বুধবার বন্দর উপজেলার কলাগাছি এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ছয়টি লাশ উদ্ধারের পরদিন আধা কিলোমিটারের মধ্যেই অপর লাশটি পাওয়া যায়। শান্তিগর গুচ্ছগ্রামের পাশের এ নদীতে সড়ক পথে যাওয়ার জন্য বন্দর থেকে কলাগাছি পর্যন্ত গিয়ে অন্তত ২০ মিনিট হেঁটে যেতে হবে। নৌপথে সেখানে যাওয়া যাবে নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে ট্রলারে। অথবা মদনপুর দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
আলামত দেখে তদন্তকারীরা মনে করছেন, হত্যার পর ওই এলাকায় নিয়েই লাশগুলো ফেলা হয়েছে। কারণ দূর এলাকা থেকে ইটবাঁধা অবস্থায় লাশগুলো এতো দূর ভেসে আসতে পারবে না। আবার কচুরিপানার কারণে এখানে ভেসে ওঠা লাশগুলোও দূরে যেতে পারেনি। হত্যাকারীরা নৌ-পথে সেখানে গেছে বলেও ধারণা তদন্তকারীদের।
লাশের সঙ্গে বাঁধা ইট ও দড়ির আলামত দেখেও ধারণা করা হচ্ছে, আশপাশের এলাকায়ই সাতজনকে হত্যার পর নদীতে ফেলা হয়েছে। এসব আলামত ধরে তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে।