ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষরের পরও একাধিক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী কমিটি।
সোমবার বেলা সাড়ে ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও স্থায়ী কমিটির প্রধান নাজনীন সুলতানার অফিস কক্ষে ফখরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কমিটির অপর তিন সদস্য নির্বাহী পরিচালক মো. আহসান উল্ল্যা, আহম্মেদ জামাল ও জিএম মো. নাসিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। কমিটির সদস্য মো. আহসান উল্ল্যা বাংলামেইলকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, ব্যাংক-কোম্পানি আইনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে খুব শিগগিরই বেসিক ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করার জন্য এ ব্যক্তিগত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। অপসারণের সর্বশেষ প্রক্রিয়ায় এমডি ব্যক্তিগত শুনানিতে আগ্রহী কিনা তা জানানোর জন্য গত বুধবার পর্যন্ত সময় বেধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বুধবার দিন শেষে তিনি ব্যক্তিগত শুনানিতে সম্মত আছেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার তিনি শুনানিতে অংশ নেন।
এ প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য মো.আহসান উল্ল্যা বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষরের পরও একাধিক আর্থিক অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বেসিক ব্যাংকের এমডির কারণ দর্শানো নোটিস দেয়া হয়। কিন্তু নোটিসের জবাবে অস্পষ্টতা পাওয়া যায়। তাই তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সরাসরি শুনানির জন্য একটা সুযোগ দেয়া হয়। শুনানিতে আজ (সোমবার) এমডি অংশগ্রহণ করেন।’
তিনি বলেন, ‘এসময় বিভিন্ন বিষয়ে শুনানি হয়েছে। তবে আরও তদন্তের জন্য এমডির কাছে বেশ কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। খুব শিগগির ওই সব তথ্য নিয়ে তিনি সশরীরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আসবেন। তবে সেদিন শুনানিতে শুধু তথ্য সংগ্রহ করা হবে।’
আহসান উল্ল্যা আরও বলেন, ‘এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেসিক ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করা হবে কিনা সে ব্যাপারে গভর্নর বরাবর সুপারিশ করা হবে। তারপর গভর্নর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের এমডিকে ব্যাংক-কোম্পানি আইনের ৪৬নং ধারায় কেন অপসারণ করা হবে না? এ মর্মে এমডির প্রদত্ত ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর করণীয় নির্ধারণে কয়েক দফায় বৈঠক করেছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী কমিটি।
ওই কমিটি বেসিক ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ আত্মসাতের ঘটনায় এমডির ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। যদিও প্রতিটি অনিয়মে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রয়েছে।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয়ে থাকায় এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কমিটি এমডিকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের চিন্তা-ভাবনা করছে। সে সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিতে পারে।
ব্যাংক-কোম্পানি আইন ১৯৯১ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৪৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ব্যাংক-কোম্পানির চেয়ারম্যান বা কোনো পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্তৃক কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা উহার আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ রোধকল্পে বা জনস্বার্থে উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, উক্ত চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীকে, যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, অপসারণ করা প্রয়োজন তাহা হইলে বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া, আদেশের মাধ্যমে উক্ত চেয়ারম্যান, পরিচালক, প্রধান নির্বাহীকে তাহার পদ হইতে অপসারণ করিতে পারিবে। ৪৬(খ) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এতদুদ্দেশ্যে যে ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে নিযুক্ত করিবে সেই ব্যক্তি উক্ত কোম্পানির চেয়ারম্যান বা ক্ষেত্রেমতো পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী হিসাবে কার্য করিবেন।’
এর আগে গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বেসিক ব্যাংকের এমডিকে কেন অপসারণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে নোটিস দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নোটিসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে গত জুলাইয়ে এমওইউ স্বাক্ষরের পরও গুলশানসহ কয়েকটি শাখার মাধ্যমে নতুন করে ঋণ অনিয়মের কারণ জানাতে বলা হয়।
একই সঙ্গে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মো.রুহুল আলম ও মোহাম্মদ সেলিমকে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার কারণ জানাতে বলা হয় ওই নোটিসে।
নোটিসের জবাবে কাজী ফখরুল ইসলাম আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ত্রুটিপূর্ণ অনেক ঋণের বিপরীতে এরই মধ্যে গ্রাহক থেকে তারা সিকিউরিটিজ নিয়েছেন। অর্থ জমার শর্তে অনেক গ্রাহক থেকে চেক জমা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঋণ আদায় ও তদারকির জন্য ব্যাংক থেকে আলাদা টিম গঠন করা হয়েছে। এরপরও যেসব ঋণে কিছুটা ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধনে শাখা পর্যায়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এর আগে গত ১৫ এপ্রিল বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের ডিএমডি আবদুল মোনায়েম খান, মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জয়নুল আবেদীন চৌধুরী, খন্দকার শামীম হাসান ও মোহাম্মদ আলী, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. শিফার আহমেদ (গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক) এবং ডেপুটি ম্যানেজার জাহিদ হাসানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে।
তবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বরখাস্ত করা হয়নি এই মর্মে পাঁচ কর্মকর্তা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন, যা এখনও বিচারাধীন।