বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশ কন্যাশিশুর ১৫ বছরের আগে এবং দুই-তৃতীয়াংশ কন্যাশিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়। গ্রামে এ হার ৭১ শতাংশ এবং শহরে ৫৪ শতাংশ। এমনই এক চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক গবেষণায়।
গবেষণায় দেখা দেখা গেছে, সেখানে মোট পুরুষের ৯২ শতাংশ বাল্যবিবাহ সম্পর্কে শুনেছেন এবং নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৯৩ শতাংশ। তারা কেউ শুনেছেন মিডিয়ার মাধ্যমে, কেউ এনজিও’র মাধ্যমে, কেউ শিক্ষকের কাছে। তবে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে ধারণার ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়েছে।
বাল্যবিবাহের শাস্তি সম্পর্কে অধিকাংশের স্বচ্ছ ধারণা নেই বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে অধিকাংশ আইনজীবী, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি আইনের দুর্বলতার কথা বললেও সরকারি কর্মকতা যেমন- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ১৯২৯ সালের বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা যায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
সেখানকার গবেষণার আওতাভুক্ত শরীয়তপুরকে বাল্যবিবাহ প্রবণ এলাকা বলে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শরীয়তপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত মোট ১৩ জন ছাত্রী বিবাহিত, যারা ২০১৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন এবং তাদের প্রত্যেকের ১৫ বছরের পূর্বে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণায় আরো উঠে আসে, শরীয়তপুরে বাল্যবিবাহের ধরনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়ের সঙ্গে অধিক বয়সের ছেলে, কখনো বা দ্বিগুণ বয়সের ছেলের বিবাহ সম্পন্ন।
শরীয়তপুরে বাল্যবিবাহের কারণ সম্পর্কে গবেষণায় যা উঠে এসেছে সচেতনতার অভার, দারিদ্র্য, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, যৌতুক অন্যতম।
বাল্যবিবাহের ফলে যে প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা হচ্ছে শারীরিক দুর্বলতা, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দাম্পত্য কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, বহু বিবাহ।
বাল্য বিবাহের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে দেখা যায়, প্রশাসনিক পদক্ষেপ, বেসরকারি নজরদারি, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, নারী শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি কারণে শরীয়তপুরে বাল্য বিবাহের প্রবণতা পূর্বের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে।
বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে শরীয়তপুরে সরকারি কোনো ভূমিকা আছে কি না- এমন প্রশ্নে অধিকাংশই মনে করেন, সরকারিভাবে ভূমিকা রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে জরিপে অংশ নেওয়া ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা তেমনটিই মনে করেন। তবে গৃহীত পদক্ষেপ কতটা কার্যকর- এমন প্রশ্নে বেশিরভাগ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকারিভাবে গৃহীত পদক্ষেপ কার্যকরভাবে বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারছে না। এছাড়া স্থানীয় সরকারের ভূমিকাও যথেষ্ট নয়।
এছাড়া, শরীয়তপুরে খুব অল্প সংখ্যক এনজিও এবং মিডিয়াসহ ছাত্র-ছাত্রী, নাগরিক সমাজ, বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
গবেষণায় উঠে আসা পর্যালোচনা সাপেক্ষে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৩’-এর পরিবর্তে ‘শিশুবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৩’ করা; ‘বাল্যবিবাহ’ শব্দটির পরিবর্তে ‘শিশুবিবাহ’ শব্দটি সর্বত্র ব্যবহার করা; বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে কমপক্ষে দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে চ্যাপ্টার সংযোজন করা; বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ প্রচার চালানো, এক্ষত্রে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ সংশোধন সাপেক্ষে সময়োপযোগী করা; আইনের শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কঠোর করা; নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধিরোধ করতে প্রশাসনিক পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ; বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে চলমান আইনের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রশাসনিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জন্মনিবন্ধন ডিজিটাল করা; জন্ম সনদে বয়স বৃদ্ধিরোধে সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার; বিবাহ নিবন্ধকের জন্য সরকারিভাবে কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রবাসীপাত্রের সাথে বিবাহ দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করতে সামাজিক প্রচার এবং বিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
এ সম্পর্কে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আগের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটির বিভিন্ন ফাঁকফোকর থাকার কারণে বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আইনটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত বাল্যবিবাহ আইন (খসড়া) ২০১৩ এর সংশোধনী আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর আইনটি বাস্তবায়ন করা হবে আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় দিক বিবেচনা করে।
অপরাজেয় বাংলাদেশ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, সমাজে নারী ও শিশু হলো ব্যারোমিটারের মতো। যে সমাজে নারী ও শিশুকে বাদ দেওয়া হয় সে সমাজকে ন্যায্য সমাজ বলা যায় না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টকরে শিশু ও নারীর অধিকার উল্লেখ করা আছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন হয়।
তিনি আরো বলেন, দেশে অভিভাবকরা বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে এখনো সচেতন হননি। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে প্রথমে ঘরের ভেতরটা পরিবর্তন করতে হবে। ঘরের ভেতরটা পরিবর্তন না করলে বারবার পিছিয়ে যাব।