নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ: দুর্ভোগেও আনন্দ

0

নাড়ির টানে ছুটতে শুরু করেছে মানুষ। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতেই গ্রামের উদ্দেশে এই ছুটে চলা। কিন্তু যাত্রাপথের শুরুতেই পরিবহন বা টার্মিনালকেন্দ্রিক দুর্ভোগ, হয়রানি ও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বাড়িমুখো মানুষকে। শুক্রবার রাজধানীর তিনটি প্রধান বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে ঘরমুখো মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। তবে বাস টার্মিনালে যাত্রীদের টানা-হেঁচড়া, লাগেজ-ব্যাগ চুরি, বেশি ভাড়া আদায়, টিকিট না পাওয়া, সময়মতো গাড়ি বা লঞ্চ না ছাড়াসহ নানা দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে যাত্রীদের। কিন্তু তাতে কী? ঈদ বলে কথা। গ্রামের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে, পরিবারের সদস্য, বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও একসঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো যাবে- সবকিছু মিলিয়ে এ এক অন্যরকম আনন্দ। ফলে যাত্রা শুরুর দুর্ভোগেও বাড়ি যেতে পারার আনন্দ উপভোগ করছেন ঘরমুখো মানুষ।

eid

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনাল এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হলেও মহাসড়কে অন্য বছরের তুলনায় দুর্ভোগ অনেকাংশেই কম। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, মহাসড়কের সংস্কার, যানজট নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরলস কর্মতৎপরতা, মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম স্থাপন, যোগাযোগমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের নিয়মিত তদারকির কারণে রাজধানীর বাইরে তেমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে না যাত্রীদের। যা হয়রানি-ভোগান্তি, তা যাত্রাপথের শুরুতেই হচ্ছে। সরেজমিন শুক্রবার রাজধানীর তিনটি বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান করেও যাত্রীদের হয়রানি-ভোগান্তি ও দুর্ভোগ লক্ষ্য করা গেছে।

সায়েদাবাদে অরাজকতা : শুক্রবার বেলা ১১টা। আনুমানিক ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী তিন যুবক রিকশা থেকে সায়েদাবাদ রেলক্রসিং সংলগ্ন বাস টার্মিনালের মুখে নামছিলেন। রিকশা ভাড়া পরিশোধ করা হয়নি, এরই মধ্যে তিনজনের একজনকে ছয়-সাতজন পরিবহন শ্রমিক ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকেন পূর্ব দিকে। ওই যুবক যেন যাত্রী নয়, পকেটমার। এভাবেই জোর করে যখন ওই যুবককে ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের সামান্তা পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো ব-১১-২৪৩৭) উঠানোর চেষ্টা চলছিল, তখন অপর দুই যুবক গিয়ে তাকে উদ্ধার করে সেখান থেকে সরে যান।

জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম নামে ভুক্তভোগী ওই যুবক বলেন, ‘আমাদের তিনজনেরই গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। বাস টার্মিনালে এসে যে এরকম টানা-হেঁচড়ার মধ্যে পড়তে হবে, তা আগেই অনুমান করেছি। এটি তো আর নতুন নয়। তাছাড়া ঈদে বাড়ি যাচ্ছি, একটু ঝামেলা তো হবেই। এতেও এক ধরনের আনন্দ আছে।’

দুপুর পৌনে ১টা। টার্মিনালের মুখে দাঁড়ানো ঢাকা-সিলেট রুটের জেবি ক্লাসিক নামে একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-০৯৬৩) ওঠেন লাল জিন্স প্যান্ট ও কমলা রঙের টি-শার্ট পরিহিত সিলেটের যাত্রী আরমান। এ যাত্রী তার সিটের ওপর ব্যাগ রেখে গাড়ি থেকে নিচে নামেন। এক-দুই মিনিটের মধ্যেই আবার সিটে ফিরে দেখেন তার ব্যাগটি নেই। আশপাশের কেউ কিছু বলতে পারেন না। পরে এ যাত্রী নিচে গিয়ে পরিবহন শ্রমিক ও বাসটির টিকিট হাতে রাখা এক ব্যক্তির কাছে বিষয়টি জানালেন। তারা উল্টো এ যাত্রীকেই দোষারোপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে ব্যাগ ফেরত পেতে যাত্রীর কাছে ২০০ টাকা চান টিকিট বিক্রেতা ও শ্রমিকরা। যাত্রী আরমান উপায় না দেখে টাকা দিয়ে দেন। কিন্তু ব্যাগ আর তাৎক্ষণিক ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। পরে টিকিট বিক্রেতা আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘টেনশন করবেন না, ওটা সোহেলের কাছে আছে। সময়মতো পেয়ে যাবেন।’

প্রায় একই সময়ে বাস টার্মিনালের খুলনা-বরিশাল রুটের কাউন্টারের সামনে দাঁড় করানো ছিল মা এন্টারপ্রাইজের সুন্দরবন নামে একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-১৯৯৭)। কাউন্টার থেকে খুলনা যাওয়ার উদ্দেশে মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি টিকিট নেন। ৩০০ টাকার স্থলে টিকিট মূল্য নেয়া হয় ৫০০ টাকা। এরপর ওই যাত্রীর সঙ্গে থাকা দুটি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরা হালকা ওজনের কিছু মালামাল বাসের ছাদে দিতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। ওই বস্তা বাবদ যাত্রীর কাছ থেকে আদায় করা হয় আরও ৩০০ টাকা।

launch_ship_lonchগাবতলীতে চুরি-চাঁদাবাজি : শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা। গাবতলী বাস টার্মিনালের পুলিশ বক্সের সামনে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন নাজমা বেগম নামে এক নারী। তার লাগেজ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। নাজমা বেগম জানান, ঈদের ছুটিতে যাবেন যশোরের মনিরামপুরে। রিকশা থেকে নেমে গাবতলী বাস টার্মিনালের ভেতরে ঢুকছিলেন। তার লাগেজটি ভারি হওয়ায় বহন করতে কষ্ট হচ্ছিল। এসময় এক ব্যক্তি তাকে সহযোগিতা করার কথা বলে তার লাগেজটি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘গায়েব’। মহিলা যাত্রী এ অবস্থায় হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। ওই লাগেজে ছিল স্বজনদের জন্য কেনা নতুন জামা-কাপড়, মালামাল ও নগদ টাকা। এ ব্যাপারে গাবতলী টার্মিনালে পুলিশ বঙ্রে এসআই নাজমুল হুদা জানান, বাস টার্মিনালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্রতারক চক্র রয়েছে। পুলিশ চেষ্টা করছে নাজমা বেগমের লাগেজটি উদ্ধারের।

দুপুর ২টার দিকে গাবতলী বাস টার্মিনালের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পাশে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামতেই কুলিদের সর্দার বাদল মিয়াসহ কয়েকজন কুলি ঘিরে ধরে। যাত্রীরা নিজেরাই সিএনজি থেকে মালামাল নামিয়ে রাখেন। কিন্তু কুলিরা জোর করে লাগেজ নিতে চায়। এজন্য তারা ১৫০ টাকা দাবি করে। এই টাকা না দিলে মালামাল টার্মিনাল থেকে সরাতে পারবে না বলে কুলিরা জানিয়ে দেয়। আশপাশে পুলিশ থাকলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যাত্রী বাধ্য হয়ে কুলিদের দাবিকৃত টাকা দিয়েই লাগেজ নিয়ে যান। অন্যদিকে শুক্রবার সায়েদাবাদেও দেখা গেছে, টার্মিনাল থেকে বের হওয়া বাসগুলোকে রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য বাসপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা দিতে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। ছোট ছোট লাঠি হাতে, মুখে বাঁশি নিয়ে টার্মিনালের কিছু লোকজনই ওই টাকাগুলো আদায় করছে। তারা যানজট নিরসনের জন্য সেখানে কাজ করলেও মূলত তারাই রাস্তায় বাস দাঁড় করিয়ে রাখতে সহায়তা করছিল।

এদিকে গাবতলী বাস টার্মিনালের নিরাপত্তায় সিটিটিভি ও ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। দারুস সালাম থানার এসআই নাজমুল হুদা জানান, নিরাপত্তার জন্য গাবতলী বাস টার্মিনালে ১৮টি সিসিটিভি বসিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।

লঞ্চ টার্মিনালে সকালে ও রাতে ভিড় : ঈদকে কেন্দ্র করে শুক্রবার সদরঘাটেও যাত্রীর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সকালের দিকে যাত্রীদের প্রচন্ড ভিড় থাকলেও দুপুরে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম ছিল। তবে দুপুরের পর যাত্রীর চাপ আবারও বাড়ে।

সরেজমিন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে অবস্থানকালে দেখা গেছে, এমভি দীপরাজ লঞ্চের ম্যানেজার জসিম ঢাকা-বরিশাল রুটের টিকিট হাতে বসে আছেন কাউন্টারে। তার সামনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন। ফুরসত নেই কোনোদিকে তাকানোর। অনুরোধ করার পর কথা হয় তার সঙ্গে। টিকিটের চাহিদা কেমন জানতে চাইলে মাথা নাড়িয়েই উত্তর দিলেন, ভালো। তবে গত ঈদে যে পরিমাণ টিকিট বিক্রি হয়েছিল, এবার এখনও তা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, বরগুনা, খুলনা, হাতিয়া, ঝালকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নৌযান চলাচল করে ঢাকা নদীবন্দর থেকে। রয়েছে এমভি পারাবত, টিপু, দীপরাজ, সুন্দরবন, ঈগল, মিতালী, রফরফ, বোগদাদীয়াসহ প্রায় ১৫০টি লঞ্চ। আর ঈদের সময় প্রায় প্রতিটি লঞ্চেই ঘরে ফেরা মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।

এমভি মিতালি-৪ লঞ্চের মাস্টার মোঃ কামালউদ্দিন জানান, গত ঈদের চেয়ে এবার যাত্রীর সংখ্যা বেশি। তবে যাত্রী বেশি হলেও যাত্রাপথে কোনো সমস্যা হবে না। এবার এই রুটে নতুন ১৬টি লঞ্চ যোগ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নৌপথে ঘরমুখো মানুষের জন্য বৃহস্পতিবার থেকে ঈদের বিশেষ লঞ্চ সার্ভিস চলাচল শুরু হয়েছে। ঢাকা নৌবন্দর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ৪১ রুটের প্রায় দেড়শ’ বেসরকারি লঞ্চ ও বিআইডব্লিউটিসির রকেট-স্টিমার সার্ভিস চলাচল করে। এসব নৌযানের প্রায় ৯ হাজার কেবিনের বুকিং এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আগাম টিকিট না পেয়ে অনেক যাত্রী হতাশায় পড়েছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More