ইসরাইলি সৈন্য আটকে উল্লাস করা ফিলিস্তিনিদের অধিকার

0

3157_1আবদেল বারি আতওয়ান

অনেক আরব নগরীতে বিশেষ করে গাজায় যারা উল্লাস দেখেছেন, তারা জানেন, যেকোনো ধরনের বিজয় পেতে মুসলিম উম্মাহ কতটা ব্যগ্র ছিল। আল-আকসা ব্রিগেডের ‘আবু ওবায়দা’ যখন এক ইসরাইলি সৈন্যকে আটক করার খবর ঘোষণা করলেন এবং ঘোষণাকালে ওই সৈন্যের ছবি ও সামরিক নম্বর প্রদর্শন করলেন, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় আরবদের জন্য দীর্ঘ দিনের নির্যাতনের পর একটি ছোট বিজয়।

সম্ভবত একজন ইসরাইলি সৈন্যকে আটক করা বিরাট কোনো সাফল্য বিবেচিত হতে পারে না, বিশেষ করে কোনো বিশ্লষক যদি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন মূল্যায়নে পরিসংখ্যান ব্যবহার করে থাকেন। অবশ্য নির্যাতিত জনসাধারণ এ ধরনের ঘটনাকে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী এবং হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকেন। বস্তুত, তারা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বিবেচনা করে থাকেন। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন ওই সৈন্যের আটক এবং অন্য ২০ জনের (সংখ্যাটি বেড়ে ৩০-এ দাঁড়িয়েছে) মৃত্যুর কথা ঘোষণা করছিলেন, তখন সবাই তার মুখে কষ্ট আর পরাজয়ের চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। অন্যদিকে যেসব লোকের মধ্যে আনন্দ দেখা গেছে, তা ছিল নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও যে প্রতিরোধ চালানো হয়েছে, তার প্রতিফলন। যারা আনন্দ করেছে, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।

আলকাসাম বিগ্রেড সৈন্যদের আটক ও হত্যা করছে, আর ইসরাইলি সৈন্যরা শিশুদের খুন করছে, লোকজনসমেত বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এসব লোককে রক্ষায় নিয়োজিত যোদ্ধাদের খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে জ্বলতে থাকা ইসরাইল গণশাস্তি দিতে এটা করছে। এখানে আমরা নৈতিকতায় বিশ্বাসী প্রতিরোধ আন্দোলন এবং মানবতাহীন একটি বর্বর ও বর্ণবাদী সেনাবাহিনীর মধ্যে তুলনা করতে পারি। এই সেনাবাহিনীর কাছে হত্যা আর গুঁড়িয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

ইসরাইল ও নেতানিয়াহু একটি সঙ্কটে পড়েছেন এবং এ কারণে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে তার বস এই অঞ্চলে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার রাষ্ট্র উভয়কে রক্ষা করার জন্য। প্রেসিডেন্ট ওবামা গাজার শিশুদের রক্ষায় উদ্বিগ্ন নন। আমেরিকাও দেখতে পাচ্ছে, সে মধ্যপ্রাচ্যের পিচ্ছিল পথে হাঁটছে, ফলে সে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আরব সহানুভূতিশীলেরা নেতানিয়াহুকে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছিল গাজা উপত্যাকাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, হামাসের রকেট নিক্ষেপ করার সক্ষমতা শেষ করে দিতে, ফিলিস্তিনি অস্ত্র ভাণ্ডারের দখল নিতে এবং মাটির নিচে ও মাটির ওপরে যা কিছু আছে সবকিছু ধবংস করে দিতে। নেতানিয়াহু যখন তা পারলেন না তখন তাকে আরেক সপ্তাহ সময় দেয়ার সবুজ সঙ্কেত দেয়া হলো। যখন তিনি ইসরাইলি বাহিনীতে আরো বেশি বেশি ক্ষতি দেখতে পেলেন, তখন তারা তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছার জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন।

গাজা অতীতেও ছিল ইসরাইলিদের জন্য কবরস্থান, ভবিষ্যতে তা-ই থাকবে। এই গাজাই আইজ্যাক রবিনকে (অসাধারণ সামরিক মেধাবী বিবেচিত এই লোকটি ছিলেন ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইলি সেনাবাহিনী প্রধান) শেষ করে দিয়েছিল; এই গাজাই অ্যারিয়েল শ্যারনকে লজ্জায় ডুবিয়েছিল এবং তাকে নিঃশর্তভাবে বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করেছিল; এবং ২০০৮ সালের ‘অপারেশন কাস্ট লিডের’ ‘বীর’ ইহুদ ওলমার্ট ও জিপি লিভনির কথাও ভোলা যায় না। এখন ইসরাইলি আগ্রাসন এবং এর ধ্বংসযজ্ঞের এই পর্যায়ে অন্যতম ব্যক্তিত্ব নেতানিয়াহুর পালা।

গাজা উপত্যাকার ফিলিস্তিনিরা, পশ্চিম তীর ও লেবানের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে বসবাসরত তাদের ভাইয়েরা যখন এক ইসরাইলি সৈন্যকে আটক করার কথা শুনল, তখন তারা আনন্দে নাচতে লাগল। তারা সম্ভবত ইসরাইলের কারাগারে আটক অন্তত এক হাজার ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির সম্ভাবনায় আনন্দ প্রকাশ করছিল। ঠিক এই বিষয়টিই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে ঘৃণাকারীরা বুঝতে পারে না। এসব সংশয়বাদী আবেগ, অনুভূতি বা জাতীয় সত্তা থেকে দূরে থেকে কেবল সংখ্যার সাহায্যে প্রতিরোধ আন্দোলনের সাফল্য হিসাব করেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া অলাঁদের (তিনি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বলিষ্ঠ সমর্থক এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশক সভা নিষিদ্ধ করে মৌলিক গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করেছেন) মতে, ‘গাজার লোকদের দুর্ভোগ অবসানে আন্তরিক উদ্যোগ একান্ত জরুরি।’ এখন প্রশ্ন হলো শিশুদের রক্ত এবং তাদের পরিবারের দুর্ভোগ কখন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে? ‘শান্তি ও ভালোবাসার দূত’ বার্নাড লেভি এখন কোথায়, তিনি কেন নীরব? তিনি কি টেলিভিশনে নিহত শিশুদের ছবি টিভিতে দেখেন না?

তাদের মতামত এবং অবস্থান পুরোপুরি উল্টে গেল কেন? কখন শকুন হয়ে পড়ে শান্তির শ্বেত কপোত? কখন গাজার শিশুদের রক্ত মূল্যবান বিবেচিত হবে, কখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত যুদ্ধবিমানের হত্যা বন্ধ করতে বলা হবে?

এসব লোকের ভয় হলো, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে, তা কেবল মধ্যপ্রাচ্য বা আরব বিশ্বের বাকি অংশেই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই সম্মানজনক এবং পুরোপুরি ন্যায়সঙ্গত প্রতিরোধ আন্দোলন আরব বিশ্বের সামনে ইসলামি বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ওবামা ও অলাঁদ যত চেষ্টাই করুন না কেন, তারা এই প্রতিরোধ আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে পারবেন না বা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবেন না। কারণ নাৎসি দখলদারদের বিরুদ্ধে ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলন এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আমেরিকাকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, এটা সেগুলোর মতোই বৈধ এবং প্রশংসনীয়।

হ্যাঁ, আমরা গাজা উপত্যাকায় আমাদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন হারিয়েছি, হাজার হাজার লোক আহত হয়েছে, আরো হাজার হাজার লোক তাদের বাড়িঘর খুইয়েছে, লাখো লোক বাস্তুচ্যুৎ হয়েছে। কিন্তু তারপরও সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে অবতীর্ণ যোদ্ধাদের হাতে ইসরাইলি সৈন্যদের হতাহত হওয়া তথা ইসরাইলি সৈন্যদের পর্যুদস্ত হওয়ার ফলে ইসরাইলিদের মনে যে ভয় ঢুকেছে তা ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি সহনীয় করে তুলেছে। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে সাতটি সন্তান ও স্বামী হারানো ফিলিস্তিনি নারীটির কথা যে শুনেছে; তার ফুসফুসের ঠিক ওপরের আর্তনাদ যারা শুনেছে তারাই গাজার হৃদয়ের কথা শুনেছে। তিনি তাকে মুক্ত করার জন্য আরব দেশগুলো বা তাদের সেনাবাহিনীর দরকার নেই বলে জানিয়েছেন। আরব চ্যানেলে আমি তার সাক্ষাতকারটি সরাসরি শুনেছি। শুজাইয়াহ এলাকার ধবংস্তুপ থেকে এই নতুন আদর্শই জেগে ওঠেছে। পূর্ব গাজা সিটির নতুন বীর তারাই।

অবশ্য, আরব মধ্যস্তার কারণে গাজা উপত্যাকার জীবনহানি বৃথা হয়ে যেতে পারে বলে যে আশঙ্কা আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সেটাই এই সম্মানজনক প্রতিরোধের দৃঢ়তা নস্যাৎ করে দিতে পারে। আমি বিদেশী হস্তক্ষেপের চেয়ে আরব মধ্যস্ততাকারীদের বেশি ভয় করি। কারণ এসব লোকের কাছে নিহত নির্দোষ লোকদের রক্ত তাদের আমেরিকান স্পন্সর করা হিসাবের জমা-খরচের তুলনায় অতি নগণ্যই। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।

আবদেল বারি আতওয়ান , প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক, সাবেক সম্পাদক আল কুদস আল আরাবি

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More