ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তি বিপ্লব

0

image_66809_0তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে দেশের ব্যাংকিং সেবায়। এক দশকের ব্যবধানে আমূল বদলে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে ব্যাংকের সেবা। অর্থ লেনদেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিসেবার বিল এখন মেটানো যাচ্ছে ঘরে বসেই। পাল্টে গেছে ব্যাংকের সামনে গ্রাহকের দীর্ঘ লাইনের চিরচেনা দৃশ্য। শহর-গ্রামের দূরত্ব কমিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে আধুনিক ব্যাংকিং সেবায়।গত কয়েক বছরের চেষ্টায় তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাংকিং সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ভিসা কার্ডের মাধ্যমে ই-বাণিজ্য।

রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সবগুলো ব্যাংকই এখন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মৌলিক ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা-যেমন রেমিট্যান্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, এটিএম ইত্যাদি সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শুধু মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকই এখন এক কোটিরও বেশি, যার অধিকাংশই পল্লী এলাকার নাগরিক। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে গ্রামীণ জনসাধারণ খুব সহজে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে। এমনকি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

এ ছাড়া দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের গ্রাহকরা অনলাইনের মাধ্যমে কেনাকাটা করতে পারছে যে কোনো সময়।গতানুগতিক ধারার ব্যাংকিং থেকে বেরিয়ে এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দেশব্যাপী যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে আর্থিক সেবার নিশ্চয়তা মিলছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতেও সাহায্য করছে এটি। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে দ্রুত ও কম খরচে টাকা লেনদেন, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে অর্থের প্রবাহ সবচেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকগুলো যেন জনসাধারণের দোরগোড়ায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে পারে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ২৮টি ব্যাংককে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ব্যাংক তাদের কার্যক্রম চালু করেছে। ব্যাংকিং সেবাবহির্ভূত জনগণকে দেশব্যাপী মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সুবিধায় আনা হচ্ছে। 

তারা যাতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা পেতে পারে, সে জন্য ব্যাংকগুলোকে একটি নীতিমালার আওতায় আনতে মোবাইল ব্যাংকিং-সংক্রান্ত একটি অপারেটিং নীতিমালাও জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।অনলাইন ব্যাংকিং : অনলাইন বা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ব্যাংকের যে কোনো শাখায় লেনদেন করতে পারছে। অ্যাকাউন্ট ব্যাংকের যে কোনো শাখায় থাকুক না কেন, দেশের যে কোনো স্থান থেকেই টাকা উত্তোলন বা জমা দেওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, দেশে কার্যরত ৪৯টি ব্যাংকে ৩৭টি পুরোপুরি অনলাইন ব্যাংকিংয়ের আওতায় এসেছে। বাকি ব্যাংকগুলো আংশিক এ সেবা চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোই পিছিয়ে রয়েছে।শহরকেন্দ্রিক ই-কমার্স, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের ব্যবহার : ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে শহরের বাসিন্দরা যে কোনো সুপার শপে কেনাকাটা করতে পারছেন। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক ঋণসুবিধা পাওয়া যাচ্ছে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। ডেবিট কার্ড থাকলে যে কোনো সময় নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ঋণসুবিধা পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে। তবে পল্লী অঞ্চলে ব্যাংকগুলোর বুথ ও সুপার শপ না থাকায় এ সুবিধা এখনো কার্যকর হয়নি।

 প্রযুক্তি ব্যবহারে এজেন্ট ব্যাংকিং উদ্ভব : প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নতুন ধারণা উদ্ভব হয়েছে। যেসব স্থানে ব্যাংকের শাখা নেই সেখানে এজেন্ট নিয়োগ করে গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনায় প্রায় লক্ষাধিক ব্যক্তি কাজ করছে।ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অনলাইন ব্যাংকিং : বাংলাদেশ ব্যাংকের অগ্রাধিকার খাত এসএমই ঋণে অনলাইন সুবিধা ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে আগ্রহী গ্রহীতা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণসুবিধা পাচ্ছেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকের জনবল ও আমলাতান্ত্রিকতা কমে যাওয়ায় সুদের হারও তুলনামূলক কমছে।

অনলাইনের মাধ্যমে রেমিট্যান্স : দেশে কার্যরত বিভিন্ন ব্যাংক আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশ থেকেই এখন প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারগুলো থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে এখন দেশের নয়টি ব্যাংক কাজ করছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ইস্টার্ন ব্যাংক, ঢাকা, এবি, সাউথইস্ট, প্রিমিয়ার, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্শিয়াল, স্ট্যান্ডার্ড, সিটি ব্যাংক এনএ এবং যমুনা ব্যাংক। অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গভাবে মোবাইল ফাইনানশিয়াল কার্যক্রম চালু করেছে এমন ব্যাংকগুলো হচ্ছে জনতা ব্যাংক, সোনালী, ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা, ব্র্যাক, মার্কেন্টাইল, ব্যাংক এশিয়া, ফার্স্ট সিকিউরিটি, প্রাইম, বাংলাদেশ কমার্স, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, ওয়ান, আইএফসি এবং ইসলামী ব্যাংক।

এ ক্ষেত্রে দেশের কার্যক্রম চালু রয়েছে এমন সব মোবাইল অপারেটরের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।রয়েছে ঝুঁকি : আধুনিক ব্যাংকিং সেবা দিতে সব ধরনের তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আসা হলেও জালিয়াতির ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল লুটে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। মোবাইল অ্যাকাউন্ট ও অনলাইন অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের বিপ্লব ও ভবিষ্যৎ ব্যাংক ব্যবসায় এর ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, প্রযুক্তি সেবায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে।

ব্যাংকিং সেবায় শিশু, কৃষি ও পোশাক শ্রমিকরা উৎসাহ নিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে। সম্পৃক্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরাও। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকিং সেবার সুফল পৌঁছছে। প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমানো সম্ভব। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উন্নত ব্যাংকিং সুবিধা সাধারণ মানুষের ব্যয়সীমার মধ্যে চলে আসে। এ পদ্ধতি ব্যাংকিং কার্যক্রমকে সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী করতে সাহায্য করায় মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়াতে সহায়তা করছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More