মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী রুনা (ছদ্ম নাম)। স্কুল ছুটির পর মায়ের সাথে বাসায় ফিরছিল। সামনে মা আর স্কুল ব্যাগ কাঁধে রুনা পেছন পেছন হাঁটছিল। হঠাৎ সজোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে রুনা। ঘাবড়ে যান মা। পেছনে মেয়ের দিকে তাকাতে দেখতে পান তিনজন মাঝ বয়সী মহিলা তার মেয়েকে ঘিরে ধরেছে। তাদের সবার হাতে একটি করে কৌটা। কৌটাগুলো রুনার মুখের কাছে ধরে রেখেছে তারা। বলছে, ‘এই কৌটার মধ্যে সাপ। এদের খাওয়াতে টাকা দে’। এই দৃশ্য দেখে মা দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। ভয় না পাওয়ার জন্য মেয়েকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন। শুধু রুনা নয়, এ ধরনের কৌটাবাহিনীর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ নগরীর পথচারী ও ব্যবসায়ীরা। রাস্তাঘাট-ফুটপাথ যেখানে-সেখানে হানা দিচ্ছে এই কৌটাবাহিনী। পথচারী নারী,পুরুষ, শিশুদের কৌটার মুখে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহজ-সরল মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেও আদায় করছে মোটা অঙ্কের টাকা। নগরীর রাস্তাঘাট অলি-গলি, বাজার সব যায়গায় দল বেঁধে চাঁদাবাজি করছে এই কৌটাবাহিনী। তাদের আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি দেখে ভয়ে আঁতকে উঠছেন অনেক নারী শিশু এমনকি পুরুষেরাও।
রাজধানীর বেশির ভাগ রাস্তায় দেখা যায় দল বেঁধে চলছে এক শ্রেণীর মহিলা, যারা অনেকের কাছে বেদেনী হিসেবে পরিচিত। তাদের দলে কিশোরী থেকে শুরু করে মাঝ বয়সী মহিলাও রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে একটি করে কৌটা বা কাঠের তৈরি ছোট্ট বাক্স। তাদের দাবি কৌটার ভেতর সাপ রয়েছে। বিশেষ এই সাপ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে পারে। সাপকে খাওয়াতে তাদের টাকা প্রয়োজন। আর তাই তারা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাথ দিয়ে চলা অবস্থায় হঠাৎ করে কারো মুখের সামনে কৌটা ধরে এরা বলে ‘দে টাকা দে’। অনেকেই টাকা না দিয়ে তাদের এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন; কিন্তু বেদেনীরা তার পথ আটকে ফেলে। টাকা দিতেই হবে তাদের। একপর্যায়ে ৫ বা ১০ টাকা বের করলে সেখানেও আপত্তি। ওই ৫-১০ টাকায় হবে না। দাবি করে বসে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। টাকা বের না করা পর্যন্ত চলতে থাকে কথার ফুলঝুরি। ‘আমাদের ঘেন্না করবি না ভাই, পকেট থেকে বেশি টাকা বের কর ইত্যাদি’। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ওই পথচারীকে ২০-৩০ টাকা দিকে দিয়ে তাদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে হচ্ছে। তবে কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টো দৃশ্যও দেখা গেছে। বেদেনীদের অত্যাচারে অনেক সময় পুরুষ পথচারীরা ক্ষেপে যান। তারা ধমক দিয়ে বেদেনীদের পাশ কাটিয়ে চলে যান। এসব বেদেনীর টার্গেট মূলত স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্রছাত্রী। বিশেষ করে ছাত্রীদের সামনে সাপের কৌটা ধরলে তারা ভয় পেয়ে যায়। অনেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। এ সময় তাদের সাথে অভিভাবক না থাকলে ভয়ে তারা বেদেনীদের টাকা দিয়ে বাঁচতে চায়। বেদেনীরাও এই সুযোগ নিয়ে ওইসব ছাত্রীর কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করে থাকে। মাঝে মধ্যে বেদেনীরা ওই ছাত্রীদের মগজ ধোলাই করতে থাকে। তারা বলে ‘টাকা না দিলে তোর বিপদ হবে। পরীক্ষায় পাস করতে পারবি না। ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হবে না। তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি’ ইত্যাদি। আর টাকা দিলে পরীক্ষায় ভালো করবি, ভালো বিয়ে হবে’ প্রভৃতি প্রলোভন দেখাতে থাকে। কিছু সহজ-সরল যুবককে ভালো চাকরি পাবি, ব্যবসায় উন্নতি হবে বলে তাবিজ-কবজ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে থাকে। আর ওইসব ব্যক্তি তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যান।
ভুক্তভোগী পথচারীরা বলেন, মানুষকে সাপের মুখে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেয়া এক ধরনের চাঁদাবাজি। সন্ত্রাসীরা যেমন অস্ত্র ঠেকিয়ে চাঁদা নেয়, বেদেনীরা কৌটা দেখিয়ে চাঁদা নেয়। খোঁজ নিয়ে দেখে গেছে, এসব বেদেনী সাভার, আমিনবাজার, কেরানীগঞ্জে নদীতে ও নদীর পাড়ে বাস করে। টাকা উপার্জনের জন্য সেখান থেকেই দল বেঁধে ঢাকায় আসে। সারা দিন চাঁদাবাজি করে সন্ধ্যার আগেই ফিরে যায়। এসব বেদেনীর সবার কৌটায় সাপ থাকে না। ১০-১২ জনের একটি দলে দু-একজনের কৌটায় সাপ থাকলেও বাকিদের কৌটা থাকে খালি। বেদেনীরা বলে, আগে বিভিন্ন গ্রামে তাবিজ-কবজ বিক্রি, সিঙ্গা লাগিয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু মানুষ এগুলো এখন আর নিতে চায় না, যার কারণে আয়ের জন্য তারা এই পথ ধরেছেন।