ঢাকা: আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উত্তরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে আলোচিত হচ্ছে অঞ্চল-৩। ১০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ অঞ্চলের এর মধ্যে পড়েছে- বারিধারা আবাসিক এলাকা, নদ্দা-কালাচাঁনপুর, বনানী, গুলশান-১ ও ২, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, হাজিপাড়া, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, মালিবাগ, নাখালপাড়া, বড় মগবাজার, নিউ ইস্কাটন, মিরবাগ, মধুবাগ, মিরেরটেক, মগবাজার ওয়ারলেস কলোনী, মালিবাগসহ প্রায় ৪৫টি এলাকা।
সরেজমিনে এসব এলাকায় গিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন রিপোর্টিং কো-অর্ডিনেটরশাহজাহান মিঞা ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বাহাউদ্দিন আল-ইমরান।
ঢাকা উত্তর সিটির সমস্যার যেন অন্ত নেই। মশা, ড্রেনেজ, পয়ঃনিষ্কাশন, যানজট অন্যতম। গুলশানে গ্যাস, পানির লাইনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলছে খোঁড়াখুড়ি, মহাখালীতে উন্মুক্ত ডাস্টবিনের ময়লা আবর্জনার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে সেখানকার মানুষ। উত্তর বাড্ডা, দক্ষিণ বাড্ডার এলাকাগুলোর অলি-গলিগুলো চলাচলের জন্য অরক্ষিত। রামপুরা, মালিবাগ, মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জমে হাঁটু পানি। মালিবাগসহ বেশ কিছু স্থানে নেই স্থায়ী বাজারের সুব্যবস্থা। তাই রেললাইনের পাশেই বছরের পর বছর কাঁচাবাজার বসিয়ে কেনাবেচা চলে। গরমের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় খাবার পানির সমস্যা বেড়ে যায়। পাম্পগুলো ঠিকভাবে পানি সরবরাহ দিতে পারে না। অনেক জায়গায়ই টাকার বিনিময়ে পানি কিনতে হয়। মগবাজার ওয়্যারলেস কলোনির সামনের ডাস্টবিনের কারণে স্বাস্থ্য হুমকিতে। এ এলাকায় একটু বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সব রাস্তা। তখন ডাস্টবিনের ময়লা ভেসে ভেসে ঘরের দুয়ারে কাছে চলে আসে। আনাচে-কানাচে জমে যায়।
এছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৩ এর ফুটপাত ও অস্থায়ী বিভিন্ন দোকানে পুলিশ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঝঞ্ঝাট। তেজগাঁও শিল্প এলাকার বস্তিগুলোতে নেশা দ্রব্য কেনাবেচার রমরমা আয়োজনও হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে জনসাধারণের।
এবারের নির্বাচনে ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী ১৬ জন। তবে এই অঞ্চলে মেয়র প্রার্থী হিসেবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আনিসুল হক (দেয়াল ঘড়ি), বিএনপি সমর্থিত তাবিথ আউয়াল (বাস), জাতীয় পার্টির সমর্থিত বাহাউদ্দিন আহমেদ বাবুল (চরকা) এবং গণসংহতি আন্দোলন সমর্থিত জুনায়েদ সাকি (টেলিস্কোপ)। নানান কৌশলে ভোটের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা।
তবে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে এগিয়ে আছেন আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক। তাবিথ আউয়ালও তেমন পিছিয়ে নেই। তিনি নিঃশ্বাস ফেলছেন আনিসের ঘাড়ের ওপর।
গত শনিবার বিকেলে পূর্ব রামপুরার জাকের রোডের নূরে আলমের কাছে জানতে চাওয়া হলো তিনি ভোট দেবেন। তিনি বললেন, তার সিদ্ধান্ত নিতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে। তিনি পর্যবেক্ষণে আছেন।
তবে ওই এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী জয়ধর জানান, তিনি ভোট দেবেন আনিসকেই। আনিস একজন ব্যবসায়ী। এফবিসিআিইয়ের সাবেক নেতা। তার ভাষায় ‘আনিস অনেকটা মিশুক ও মিষ্টভাষী’।
তার পাশের দোকানদার নূরে আলমের কাছে ভোটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়র পদে দুইজন (আনিস- তাবিথ) সমান সমানই আছেন।’ একটু এগুলে চন্দন নামে আরেকজন বলেন, ‘এখনও কাউকে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিইনি। কাকে ভোট দেবো। দুইজনের একজনকেও তো চিনি না!’
রামপুরার রহমত উল্লাহ টি-স্টলে রাজনীতির আড্ডাটা ভালো জমেছে। এই চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয় একটাই। তা হলো, আনিসুল হক একজন ব্যবসায়ী। তিনি কীভাবে ঢাকাবাসীর সেবা করবেন? আসাদ নামের এক তরুণের শ্লেষাত্মক মন্তব্য, ‘সেবা তিনি ঠিকই করবেন। তবে তার নিজের ব্যবসার। এর মাধ্যমে তার ব্যবসা আরো লাভবান হতে থাকবে’।
হেঁটে এগিয়ে যাওয়া গেল আরো দক্ষিণ দিকে। দেখা গেল চায়ের দোকানে বসে আছেন শশ্রুমণ্ডিত দুই প্রবীণ। আলাপের এক পর্যায়ে একজন জানালেন তার নাম আলী ইস্কান্দার। তিনি খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। বেশ দৃঢতার সঙ্গেই বললেন, ‘এখানে জিতবেন আনিস সাহেব। তাবিথকে কয়জনে চিনে?’
তার সঙ্গী আব্দুল করিমও বললেন একই কথা। চাকরি জীবনে তিনি ওয়াপদায় আওয়ামীপন্থি সিবিএ করতেন।
সেখান থেকে একটু হেঁটে এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল রাস্তার ধারে দুই তরুণ। নাম আশিক ও শাহরিয়ার। শাহরিয়ার পড়েন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদল সমর্থক এই তরুণের মেয়র পদে পছন্দের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তাবিথের শিক্ষাগত যোগ্যতা তার ভালো লাগে।
তবে আশিক সোজাসাপ্টা বললেন, তিনি ভোট দেবেন মাহীকে। আনিস-তাবিথ ও মাহীর মধ্যে মাহীকেই তার কেবল ‘রাজনীতিক’ বলে মনে হয়। টকশোতে মাহীর বক্তব্যও তার ভালো লাগে।
রামপুরার পাশেই বনশ্রী। সি ব্লকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলেন মাঝবয়সী দুই নারী। তাদের কাছে নির্বাচনের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বপ্না নামের একজন বললেন, ‘এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি ভোট দেবো কাকে।’
তবে স্বপ্নার চেয়ে অনেকটা স্পষ্ট পশ্চিম রামপুরার আসমা খাতুন। মোল্লা টাওয়ারের পেছনে বসবাসকরা এই নারী বললেন, ভোট দেবেন তাবিথকেই। তার সঙ্গে থাকা দুই নারীর একজন আনিসের ব্যাপারে বললেও আরেকজন কিছুই বলতে চাননি।
তরুণ প্রজন্মের লোকজন ভোট নিয়ে কী ভাবছে তা জানতে বনশ্রীর ডি ব্লকে হাঁটতে হাঁটতে পাওয়া গেল দুই তরুণকে। একটি মার্কেটের সিঁড়িতে বসে গল্প করছে। সন্ধ্যে তখন ছুঁই-ছুঁই। তাদের একজন সোহানুর রহমান সোহান। আরেকজন আলম মেহেদী। তারা নতুন ভোটার। মেহেদী এখন পর্যন্ত ভোটার আইডি পায়নি। তারা আনিসুল হককে ভোট দেবে বলে জানালো। তাদের বক্তব্য, ‘আনিসুল হক তরুণদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি তরুণদের দিয়ে ঢাকায় জরিপ করেছেন। ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করেছেন।’
এই এলাকার সমস্যাগুলোর মধ্যে মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাস, চুরি ছিনতাইয়ের পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যাও প্রকট।
গত রোববার বিকেলে নদ্দায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কথা হয় সাইদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি সিমেন্ট ব্যবসায়ী। মেয়র নির্বাচনে কার পাল্লা ভারি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে মানুষজন ভোটের ব্যাপারে কিছু কইতে চায় না। অনেক ভোটারই নীরব। তবে আমি আনিসুলের বক্তব্যে সন্তুষ্ট। তার আচরণ মার্জিত, ভদ্র।’
নদ্দা জগন্নাথপুরের গাফফার ও আজমল বললেন, ‘এই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ (আনিসুল হক) পাস করবে।’ নদ্দা ও কালাচাঁনপুরে আওয়ামী লীগের সমর্থক বেশি বলে জানান তিনি। তবে আমিনুল ইসলাম বাবু যা বললেন তাতে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বিএনপি। তার ভাষায়, ‘বিএনপি প্রার্থীরা চুপ মেরে বসে আছে’।
নদ্দা-কালাচাঁনপুরসহ ওই এলাকার প্রধান সমস্যা হলো মশা ও ড্রেনেজ। যানজটেও নাকাল বাসিন্দারা। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা রইস উদ্দিনও বললেন, এই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ পাস করার সম্ভাবনাই বেশি।
নদ্দা থেকে রওনা হওয়া গেল নতুনবাজারের দিকে। সেখানে ওভার ব্রিজের পাশে চা খেতে খেতে কথা হলো পুলিশ কর্মকর্তা আবু তাহেরের সঙ্গে। নতুন বাজারের কাছেই তার বাসা। ভোটের ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি তাবিথের চেয়ে বেশ এগিয়ে রাখেন আনিসুল হককে। বলেন, ‘উনি একজন ব্যবসায়ী। তার অনেকগুলো গার্মেন্ট কারখানা আছে। ভালোভাবেই তিনি পরিচালনা করেন সেগুলো। শ্রমিকরাও তার পক্ষে কাজ করছে বলে শুনেছি।’ তাবিথের কম পরিচিতি তাকে পেছনে ফেলছে বলেও মন্তব্য করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
রাত সাড়ে ৮টা। নতুন বাজার থেকে গেলাম বাড্ডা লিঙ্ক রোড। তখন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের খেলা চলছিল। লিঙ্করোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে গুলশানের দিকে। লেকের পাড়ে কয়েকজন বসে কথা বলছে। ঘর্মাক্ত শরীরে লেকের বাতাস খানিকটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। একটু দাঁড়িয়ে এক পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ে কথা বলায় আকবর নামে একজন বললেন, ‘গুলশান-বাড্ডায় তাবিথ-আনিস জোর লড়াই হবে। দু’জনই ব্যবসায়ী। দুই জনই পয়সাওয়ালা। তবে মিন্টু সাহেব থাকলে লড়াই জমতো ভালো।’
ভোটার নয় এমন লোককে মিন্টু সাহেব কেন প্রস্তাবক করতে গেলেন তা নিয়ে একজন কথা বলা শুরু করলেও আমরা আর সেদিকে গেলাম না। নাম না জানা আরো তিনজন বললেন, ‘নির্বাচনের দু’একদিন আগে পরিস্থিতি ভালো বোঝা যাবে।’
লিঙ্করোড ধরে গুলশান-১ দিয়ে শুটিং কমপ্লেক্সের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আসিফের সঙ্গে দেখা। প্রায় দশ বারো বছর পরে ওর সঙ্গে দেখা। বাড্ডায় বসবাস করছে পরিবার নিয়ে। আসিফ জোনাইদ সাকির গুণগান গাইলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আসিফ বাম ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন নিখোঁজের ঘটনা ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে বলে তার ধারণা।
সেখান থেকে আবার পশ্চিম রামপুরার দিকে। মোল্লা টাওয়ারের পেছন দিয়ে যাওয়ার সময় এক নারীকে দেখা গেল ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফিরছেন। নির্বাচনের হালচাল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বাস মার্কার দিকে ইঙ্গিত করলেন।
পরের দিন সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় হাজির ওয়াপদা রোডে জাহাজ বিল্ডিংয়ের সামনে মনিরের চায়ের দোকান। আরো দুই খরিদ্দার ছিলেন। কথা বলতে বলতে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলো। মনিরের ভাষ্য, ‘নির্বাচন হবে ভোটের আগের রাতে। ওই দিন টাকার খেলাও হবে।’ তবে তিনি ভোট দেবেন দেয়াল ঘড়িতেই।
মশা, পয়ঃনিষ্কাশন, ড্রেনেজ ওই এলাকার সমস্যা বলেও জানালেন তিনি। তবে এসব সমস্যা ঢাকাজুড়েই নাকি আছে।
এবার যাত্রা হাজীপাড়ার দিকে। ইকরা কোচিং সেন্টারের গলি ধরে এগিয়ে যেতেই একটি সেলুন সামনে পড়লো। তিনচার জন লোক বসা। গিয়ে দাঁড়িয়ে এই এলাকার নির্বাচনের হাল-হকিকত জানতে চাইলে রিপন নামে একজন বললেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী ভালো লোক। তিনি ব্যবসায়ী। তিনি দুর্নীতি করলে আর কতোই করবেন?’
আরেকটু এগিয়ে এক ফার্মেসির দোকান পড়লো। লোকটার নাম আলামিন। তিনি এক ধরনের ব্যালেন্স করলেন। বললেন, ‘তাবিথ-আনিস দু’জনেই ভালো মানুষ।’
আবার চলা শুরু। এবার মালিবাগ বাগান বাড়ি। লন্ড্রি ব্যবসায়ী মনিরের বক্তব্য, ‘কিছু বুঝা যাচ্ছে না। বিএনপিরা লড়ে চড়ে না। চুপচাপ। তবে আমি ভোট দিবো আনিসকেই।’
সাধারণ ভোটাররা জাতীয় পার্টির প্রার্থী বাহাউদ্দিন আহমেদ বাবুলকে সরকারের ‘বি টিম’ হিসেবেই মনে করছেন। এ বিষয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার একজন মুদির দোকানদার মঞ্জুরুল ইসলামের মন্তব্য, ‘সিটি নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও তারা এক প্রকারের সরকারের লোক। জাতীয় পার্টিও এখন সরকারি দল। এই দলের প্রার্থীরে ভোট দিলে হবে না। তাইলে ভোট ওই সরকারের ঘরেই যাইবো। নির্বাচন সুষ্ঠু হইলে তাবিথই এবার জিতব।’
তবে ঢাকা শহরে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরির প্রতিশ্রুতির প্রতি সমর্থন জানান নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুশফিক করিম। তার মতে, আধুনিক ঢাকা গড়তে আনিসুল হকের মতো প্রার্থীকে সমর্থন বেশি করা উচিৎ।
অর্থাৎ এই অঞ্চলের ভোটার ও তরুণদের সঙ্গে কথা বলে বুঝা গেল, নির্বাচনী প্রচারণার বৈচিত্র্যে আনিসুল হক ভালোই এগিয়ে আছেন। বিশেষ করে তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন তিনি। অপরদিকে বিএনপির সক্রিয়তা ঘাটতি, অনভিজ্ঞ প্রার্থী সাধারণ ভোটারদের মনোযোগ সফলভাবে কাড়তে পারেননি। আর জাতীয় পার্টির ব্যাপারে রাজধানীবাসীর নেতিবাচক ধারণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।