অস্ট্রেলিয়ার আসা না আসা এবং জঙ্গিতত্ত্ব

0

Australia-vs-Bangladeshগোলাম মোর্তোজা: আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিম আক্রান্ত হতে পারে -তার কোনো সম্ভাবনা নেই। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শত ভাগের চেয়েও বেশি সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। বাস্তবে বাংলাদেশে বড় কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। আছে ছোট কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন। কোনো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের আদর্শ মনে করে, তালেবান -আল কায়েদা -আইএসকে।

আফগানিস্থানে তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করা কিছু মানুষ এসব সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রমাণ অতীতে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে। তাদের শক্তি -সামর্থ কোনো ভাবেই জঙ্গি সংগঠন বলতে যা বোঝায়, তাদের মত নয়। তাদের সঙ্গে এদের কোনো তুলনাই চলে না।

প্রশ্ন হলো, জঙ্গি সংগঠন বলতে আসলে কি বোঝায়? আমেরিকা -ইউরোপ -অস্ট্রেলিয়া …জঙ্গি সংগঠন বলতে কি বোঝে?

১. জঙ্গি সংগঠন বলতে তারা তালেবান -আল কায়েদা বা আইএসকেই বোঝে।

২.  সরকার বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের কিছু সন্ত্রাসী মানসিকতার লোকজনকে ধরে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের সঙ্গে আল কায়েদা বা আইএসের সম্পৃক্তার কথা ফলাও করে প্রচার করে।

৩. গত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় -জঙ্গলে ‘বড় বড় ‘ বেশ কয়েকটি জঙ্গি ঘাঁটি আবিস্কার করেছে সরকার। সরকারের ভাষায় সেখানে জঙ্গিরা ট্রেনিং নেয়। পাওয়া যায় ‘বিপুল পরিমাণ’ গোলা -বারুদ।

৪. দেশের আরও কিছু অঞ্চল থেকে কখনও কখনও পাঁচ সাত জনকে গ্রেপ্তার করে,  আইএস বা আল কায়েদার সঙ্গে তাদের  সম্পৃক্ততা আছে বলে প্রচার করা হয়।

৫. একের পর এক ব্লগারদের হত্যা করছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা ‘ নামক একটি অদৃশ্য সংগঠন। ব্লগার হত্যাকান্ড নিয়ে সরকারের সীমাহীন ব্যার্থতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। যদিও সরকার দাবি করছে কয়েক জন ব্লগার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

৮. এই সংবাদগুলো আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমেও স্থান পায় মাঝেমধ্যেই। বাংলাদেশে ব্লগার হত্যাকাণ্ড তো সারা পৃথিবীর প্রচার মাধ্যমের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।

৯. এই সংবাদগুলো আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে যারা পড়বেন, তারা কী ভাববেন? বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আছে না নেই? ঢাকাস্থ প্রতিটি দূতাবাস দেশের সংবাদ মনিটর করে। রাজনীতিবিদ -মন্ত্রীরা বিরুদ্ধ মতের প্রায় সবাইকে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপণ করে প্রতিনিয়ত বক্তৃতা করেন। বিরুদ্ধ মতের দল ও মানুষকে জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে কথা বলেন।

৯. পার্বত্য চট্টগ্রামে আরাকান আর্মি কর্তৃক বিজিবির আক্রান্ত হওয়া, আরাকান আর্মির উপস্থিতির সংবাদ তো সবাই নানা মাধ্যমে জানছে। সরকারের দিক থেকে খুব সন্তোষজনক বা বিশ্বাসযোগ্য কোনো সংবাদ কি জানা গেছে?

১০. পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী ও চুক্তি এবং বাংলাদেশ বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে কারা তৈরি করেছে, কারা টিকিয়ে রেখেছে? ১/১১’র সময় জেএসএস (সংস্কারপন্থী)  কারা তৈরি করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে?

১১. আমাদের সরকারগুলো কাজ করে সাময়িক সুবিধার কথা এবং একদিক বিবেচনায় রেখে। সুদুরপ্রসারী এবং অন্য দিকের কথা তাদের বিবেচনায় থাকে না। যেমন বিএনপি -জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রীরা পৃষ্টপোষকতা দিয়ে জঙ্গি বাংলা ভাই -শায়খ আবদুর রহমানদের তৈরি করেছিল। গণমাধ্যম তাদের ঘটানো হত্যাকান্ড এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সংবাদ প্রকাশ করেছে। তখন সরকার শুধু অস্বীকার করেছে। যুক্তি ছিল প্রচার পেলে দেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু নিজের দলের মন্ত্রী -নেতাদের পৃষ্টপোষকতা দেয়া থেকে বিরত রাখার কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। বাংলা ভাইদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। অবশেষে দেশব্যাপী বোমা ফাটানোর পর আন্তর্জাতিক চাপে ব্যবস্থা নেয়া হয়, নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয়, বিচার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয় এসব সন্ত্রাসী জঙ্গিদের।

১২. বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা সব সময়ই বলেছে। আমরা তা বিশ্বাস করেছি। কারণ জঙ্গি মানসিকতার এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর থেকে সরকারের পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু একটা সময়ে এসে দেখা গেল, ক্ষমতায় থাকার কার্ড হয়ে গেল জঙ্গি -সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সরকার একটা নাজুক অবস্থায় পড়লেই ‘বড় ‘ জঙ্গি গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটতে থাকলো।

১৩. প্রমাণ করার একটা চেষ্টা দৃশ্যমান করে তোলা হলো যে, দেশে আল কায়েদা, আইএসের নেটওয়ার্ক সক্রিয়। বিএনপি -জামায়াত পৃষ্টপোষকতা করছে আইএস, আল কায়েদাদের। যেহেতু বিএনপি -জামায়াত এক সময় বাংলা ভাইদের তৈরি করেছে, সুতরাং তাদের ওপর এই দায় চাপানো সহজ হয়েছে। আন্দোলনের নামে বিএনপি -জামায়াতের সহিংসতা, পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসও জঙ্গিবাদ হিসেবে দেখাতে সক্ষম হয়েছে সরকার।

১৪. ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন যেহেতু দেশের বাইরের শক্তিগুলোও মেনে নেয় নি, সরকার নিজেদের অপরিহার্যতা বোঝাতে ব্যবহার করেছে জঙ্গিবাদকে। বাংলাদেশে আইএস, আল কায়েদা সক্রিয়, আমরা তাদের গ্রেপ্তার করে ব্যাবস্থা নিচ্ছি। আমরা ক্ষমতায় না থাকলে, বিএনপি -জামায়াত ক্ষমতায় আসবে। বিএনপি -জামায়াত যেহেতু আল কায়েদা, আইএসের পৃষ্টপোষক, সুতরাং তখন বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ছোট সন্ত্রাসী মানসিকতার জঙ্গিদের ‘বড় ‘ জঙ্গি ‘ আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এদিক দিয়ে সরকার লাভবান হয়েছে। দেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব বিশ্বাস করাতে সরকার সক্ষম হয়েছে।

১৫. সেই বিশ্বাস এবং তার সঙ্গে আরও দু ‘একটি বিষয় হয়ত অস্ট্রেলিয়ার নীতি -নির্ধারকদের নজরে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী এনেছে, যারা চায়না অস্ট্রেলিয়া আসুক বাংলাদেশে। নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি অস্ট্রেলিয়া আন্তরিকভাবে অনুসন্ধান করলে খুব সহজেই বুঝবে যে, বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদার নেটওয়ার্ক সক্রিয় নেই। কোনো ঘাঁটি বা ট্রেনিং সেন্টার নেই। কিছু সন্ত্রাসী মানসিকতার জঙ্গি আছে, তাদের শক্তি -সামর্থ -নেটওয়ার্ক অত্যন্ত সীমীত। বড় কোনো আঘাত করার ক্ষমতা নেই তাদের। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। এটা নিয়ে সন্দেহ পোষণের সামান্যতম কোনো কারণ নেই।

১৬. হয়ত অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে আসবে। সরকার যে দিকটি এতদিন চিন্তা করেনি, সে দিকটি কি চিন্তা করবে? সে অনুযায়ী কাজ করবে?

আর অস্ট্রেলিয়া যদি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে না আসার সিদ্ধান্তই নেয়, তার কি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর? সেটা বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করবে, না অস্ট্রেলিয়াকে বর্ণবাদি বলে বিষাদগাঢ় করতে থাকবে?

১৭. জঙ্গি নিয়ে খেলাধূলা করতে করতে পাকিস্তান জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিপদ থেকে বের হয়ে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে পাকিস্তানের। সে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক কম বিপদজনক। পথ এখনও খোলা। ইচ্ছে করলেই খোলা পথ দিয়ে বিপদ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে বাংলাদেশ। বের হয়ে আসতে চায় কিনা, তা নির্ভর করছে ক্ষমতাসীনদের আন্তরিক বোধদ্বয়ের উপর। অস্ট্রেলিয়ার এই আচরণকে আশির্বাদ -অভিশাপ দু ‘ভাবেই দেখার সুযোগ আছে । সঠিক সিদ্ধান্তে অনেক অল্পতেই রক্ষা পেতে পারি, ভুল সিদ্ধান্তে আরও জটিল জালে জড়িয়েও পড়তে পারি।

সূত্রঃ প্রিয়.কম

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More