“তোমার কাছ থেকে এসেছি, তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে,
পৃথিবীর যত আলো আশা, যত প্রেম যত ভালবাসা
সবকিছু ছিণ করে প্রভু, তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।”
হ্যাঁ; পৃথিবীর সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। আর তা হলো মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। নিজের লেখা এমন গানের কাছে নতি স্বীকার করে মহান প্রভুর ডাকে তাঁর কাছেই চিরতরে ফিরে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রে একসময়ের সাড়া জাগানো অভিনেতা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শেখ আবুল কাশেম মিঠুন।
সুন্দরবনের লোনাপানিতে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি এক সময় বাংলাদেশের রূপালী পর্দা কাঁপালেও হেরার রশ্মি তাঁকে সেখানে টিকে থাকতে দেয়নি। তিনি ফিরে আসেন তাওহীদের পথে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। শুরু করেন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের নতুন জীবন। নিজ প্রতিভার গুণেই তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের বাংলা মিঠুন। সিলেটের সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার দুরন্ত অভিযাত্রী “দিশারী শিল্পীগোষ্ঠী”র সাথে সম্পৃক্ত থাকায় খুব বেশী না হলেও ৭/৮ বার দেখা ও কথা হয়েছিল ক্ষণজন্মা এই মহান ব্যক্তির সাথে। তবে তাঁর লেখা কলাম, গান ও চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিতি যেন জনম জনমের। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মিঠুন ভাইয়ের চিরবিদায়ের প্রায় দেড় মাসেরও বেশী সময় অতিবাহিত হল। ব্যক্তিকেন্দ্রীক ব্যস্ততা থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ২ লাইন লেখা সম্ভব হয়নি। ফলে বিবেকের তাড়নায় অনেকটা বাধ্য হয়েই কিছুটা দেরিতে হলেও মিঠুন ভাইকে নিয়ে লিখতে বসলাম।
নিঃস্বার্থ, নিরঅহংকারী, সদালাপী মানুষ হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর ছিল ব্যাপক পরিচিতি। শুধু নায়ক বা অভিনেতা হিসেবেই নয়, তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির। এই সংগঠনের তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এফডিসি পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে কতটা জনপ্রিয় হতে হয়। পিতা মাতা প্রদত্ত নাম শেখ আবুল কাশেম। কিন্তু বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘মিঠু’ বলে। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করে ‘মিঠু’ হয়ে যান ‘নায়ক মিঠুন’। এই নামটি শুনলেই বাংলাদেশের মানুষ তাকে এক নামেই চেনেন।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন ঘেষা আশাশুনি উপজেলার দরগাঁহপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ আবুল হোসেন ও মা হাফেজা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। শেখ আবুল কাশেম মিঠুন সঙ্গীতা ও তরী নামের দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাঁগদাদী (রহ.) স্ত্রীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদ থেকে আসেন। আশাশুনি উপজেলার দরগাঁহপুর এসে তিনি এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে তিনি এখানেই বসতি গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান আলেম। মানুষের কাছে শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাঁগদাদী (রহ.) ছিলেন পীর বলে খ্যাত। দরগাঁহপুর গ্রামেই তাঁর দুই সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। উক্ত পুত্রদ্বয়ের বংশধরগণ দরগাঁহপুরের আদি অধিবাসী। শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাঁগদাদী (রহ.) অন্যতম সপ্তম উত্তর পুরুষ মরহুম শেখ আব্দুল মতিন। শেখ আব্দুল মতিনের দৌহিত্র শেখ আবুল কাশেম মিঠুন। পারিবারিকভাবেই শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ছিলেন অভিজাত ইসলামী পরিবারের সন্তান।
১৯৭২ সালে তিনি জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত পাইকগাছা উপজেলার রাড়–লির আরকেবিকেএইচসি ইনস্টিটিউট হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে খুলনা সিটি কলেজে থেকে এইচএসসি পাশ করে একই কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। এ সময় তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে নূর মোহাম্মদ টেনা সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কালান্তর’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ‘কালান্তর’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন। সাংস্কৃতিক মনা শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম অভিনিত ছবি ‘তরুলতা’। প্রথম ছবিটিতেই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তারপর থেকে একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। মিঠুন অভিনিত ছবিগুলোর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো ‘ঈদ মোবারক’, ‘ভেজা চোখ’, ‘নিকাহ’, ‘কুসুমকলি’, ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘নিঃস্বার্থ’, ‘সাক্ষাৎ’, ‘স্বর্গনরক’, ‘ত্যাগ’, ‘চাকর’, ‘জিদ’, ‘চাঁদের হাসি’, ‘নরম-গরম’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘এ জীবন তোমার আমার’, ‘খোঁজ-খবর’, ‘ছোবল’, ‘কসম’, ‘দিদার’, ‘পরিচয়’ ‘মাসুম’, ‘কুসুমকলি’, ‘দস্যু রাণী ফুলন দেবী’, ‘জেলহাজত’, ‘ত্যাজ্যপুত্র’, ‘সর্দার’, ‘অন্ধ বধূ’, ‘অনন্য’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘চন্দনা’, ‘ডাকু’, ‘স্যারেন্ডার’, ‘বাবা কেন চাকর’ প্রভৃতি। নায়ক ছাড়াও তিনি সিনেমার পার্শ্ব চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এ-ছাড়াও তিনি অসংখ্য সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপরও তিনি স্ক্রিপ রাইটার ও গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়।
অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আমৃত্যু সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নৈতিকতাসম্পন্ন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়া যাবেনা । ২০১০ সালের ১১ আগস্ট (প্রথম রমজানের সেহরীর সময়) বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, কবি ও গীতিকার, ইসলামী সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান মল্লিক ইন্তেকাল করেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিকেরই নিরলস প্রচেষ্টায় সারা দেশে নতুন ধারার ইসলামী সঙ্গীত চর্চা শুরু হয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে। খ্যাতিমান এই কবির মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র’র হাল ধরেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ২০১৪ সালের মার্চে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। একটু সুস্থবোধ করলেই তিনি আবার শুরু করেন সংস্কৃতি চর্চা। রাজধানী ছেড়ে ছুটে বেড়ান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তারই ধারাবাহিকতায় কয়েকবার এসেছেন সিলেটেও। সর্বশেষ তিনি ২০১৪ সালের শেষের দিকে যখন সিলেট আসেন। তখন খুব অল্প সময় কথা হয়েছিল মিঠুন ভাইয়ের সাথে। তিনি যে কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তার কথাবার্তায় তা কখনো ফুটে ওঠেনি। তার প্রাণোচ্ছ্বল আচরণের কারণে আমরা তা কখনো টেরও পাইনি।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন কিডনি, লিভার, হার্ট ও লান্সের সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই ২০১৫ সালের ১১ মে তিনি তাঁর অসুস্থ মা হাফেজা খাতুনকে দেখতে খুলনায় যান। অসুস্থ মাকে দেখতে এসে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৪ মে বিকেলে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৮ মে পর্যন্ত তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯ মে সকালে তাকে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. পিবি শুকলা এবং কোটারি হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শামীমুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোটারি হাসপাতালে ২৪ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। ২৬ মে সন্ধ্যা ৭টায় পেট্রাপোল সীমান্ত পার হয়ে মরদেহ দেশে পৌঁছে। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সে রাত ১০টায় মরদেহ দরগাঁহপুর গ্রামে নেয়া হয়। ওই দিন রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে দরগাঁহপুর আর.কে.বি.কে কলেজিয়েট স্কুল মাঠে স্মরণকালের বৃহৎ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন মিঠুনের চাচাতো ভাই মাওলানা জাহিদুল বাশার। জানাযা শেষে নারকেলবিথি ও গাছ-গাছালিতে ভরা পারিবারিক কবরস্থানে শেখ আবুল কাশেম মিঠুনকে দাফন করা হয়। তিনি যে এলাকার মানুষের ভালবাসায় বেড়ে ওঠেছিলেন, যে মাটি ও বাতাসে বড় হয়েছিলেন সে মাটিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন।
“ হাজারো স্বপ্ন ছিল যে আমার জাহেলি জীবনে
অন্তর ছিল অস্থির আর অশান্ত অকারণে।
ধন, মান আর সম্পদ ঘিরে, স্বপ্নগুলো কিলবিল করে
নিশিদিন যেন রক্ত ঝরে, কাল সাপের দংশনে।”
স্বরচিত এই গানটির হৃদয়গাহী আকুলতা প্রমাণ করে রূপালী পর্দা থেকে হেরার পথে চিত্রনায়ক আবুল কাশেম মিঠুনের ফিরে আসাটা চিল অনিবার্য। এক সময়কার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মিঠুন ফিরে আসেন ইসলামী সংস্কৃতি ধারায়। এরপর তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে কাজ করে গেছেন। গানের পাখি ও চির সবুজের কবি মতিউর রহমান মল্লিকের পথের পথিক হয়ে ২০১৫ সালের ২৪ মে দিবাগত রাত ২টায় চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর কোন দিন তিনি সিলেটের সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার প্রত্যয়দীপ্ত আন্দোলন “দিশারী শিল্পীগোষ্ঠী”কে পরামর্শ কিংবা উৎসাহ দিতে আসবেন না। সাহসী কন্ঠে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলবেন না আর কথা। লিখবেন না আকাশ সংস্কৃতির নামে দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে। তবুও তার চিন্তা-চেতনা সংস্কৃতি অঙ্গনে চির অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও তার সৃষ্টিশীল কর্ম থাকবে চির জাগরুক। পরিশেষে একটাই প্রত্যাশা পরজনমে ভালো থেকো মিঠুন ভাই। আর দোয়া করি আল্লাহর কাছে প্রিয় শ্রদ্ধাশীল মিঠুন ভাইকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমীন।