ওদের জঙ্গি বলবেন না, প্লিজ। বলুন বিপথগামী, বিপদগামী। আবারো বলছি, ওদের দোষ দেওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে প্রশ্ন করুন, কেন ওরা আজ ভয়ংকর পথে গেল, বিপদে পড়ল। ওদের সামনে আশার দরকার ছিল। কিন্তু ওরা হতাশায় ডুবেছে বারবার।[ads1]
দেশের কলুষিত রাজনীতি, বুদ্ধিজীবীদের ভ্রষ্টতা, পরিবারের ভালবাসার বন্ধনহীনতা, কোন্ ভাল উদাহরণটা ছিল ওদের সামনে? অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল ওদের। কিন্তু কেনো ১৭-২৫ বছরের জীবনেই সুন্দর সম্ভাবনার ইতি ঘটল। কেনো? কারা আমাদের সিস্টেমহীনতার সুযোগ নিয়ে ওদের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পথে নিয়ে গেল?
জীবনের সবচেয়ে সুন্দরকাল হলো তারুণ্যের কাল। সেই সময় একজন তরুন যখন তার সবচেয়ে মূল্যবান এবং একমাত্র সম্পদ সেই জীবনটি দিয়ে দেয়, তখন রাষ্ট্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজ চিন্তক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবার প্রধান, সমাজপ্রধান, দেশের জনগণ হিসেবে আপনাদের ভেবে দেখতে হবে। ভেবে দেখতেই হবে কেনো তারা এটা করল?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, কেনো ওরা বিপথে গেল, বিপদে পড়ল। ওদের জঙ্গি বলার আগে তাই আপনার দায়টাও সামনে আনতে হবে। আপনিও এখানে হুকুমের আসামী।
প্রিয় রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালক, আপনি তৃণমূলের সম্ভাবনাময় তরুনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পর্কে কতটুকু জানেন? জানেন না। বরং তাদের নিয়ে রাজনীতি করেন। ব্যবহার করেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চিন্তা করেন, রাষ্ট্রের কল্যাণ করে ইতিহাসে অমরত্ব লাভের চিন্তা করেন না। মনে রাখবেন, ২১ বছর বয়সে মারা যাওয়া সুকান্ত ভট্টাচার্য কিন্তু এখনো বেঁচে আছেন। অথচ তার সময়ের অনেকে একশ বছর বেঁচেও এখন আর বেঁচে নেই। তাদের নাম ইতিহাসে নেই।
প্রিয় সাংবাদিক-সম্পাদক, আপনি আপনার মিডিয়ায় দেশের প্রকৃতচিত্র তুলে ধরে কি রাষ্ট্র পরিচালকদের সহায়তা করেছেন? করেননি। দিনের পর দিন শুধু তোষামোদি অথবা কারো বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে গেছেন। না হয় ভয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেননি, মেরুদণ্ডের শক্তিহীনতার কারণে। অথচ সাহস করে সত্য তুলে ধরলে রাষ্ট্র পরিচালকদের রাষ্ট্র পরিচালনায় উপকার হতো।[ads1]
প্রিয় সমাজচিন্তক, আপনি সমাজের কোন গবেষণাটা করে বদলে যাওয়া সামাজিক আবহ নিয়ে একটা লেখা লিখেছেন? এই যে চোখের সামনেই শান্তির যৌথ পরিবার প্রথা বিলীন হয়ে গেল, কই লিখলেন যৌথপরিবারের পক্ষে সুন্দর অনুপ্রেরণাদায়ী একটি লেখা? লেখেননি।
প্রিয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আপনি টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের ছেড়ে দিচ্ছেন, নিরপরাধকে জেলে পুরছেন। আপনার প্রমোশন হচ্ছে, আপনার উৎকোচের রেটও বাড়ছে। এভাবে আপনি কিন্তু আইনের মধ্যে শৃঙ্খলার সিস্টেমটাকে নষ্ট করছেন। ক্ষমতাবানকে স্যালুট দিচ্ছেন, দুর্বলকে লাত্থি মারছেন। বাহিনীর যারা ভাল তারা আপনার কারণে কোনঠাসা হচ্ছেন। কিন্তু কেনো?
প্রিয় পরিবার প্রধান, সারাক্ষণ ছুটেছেন টাকার পেছনে। ক্যারিয়ারের পেছনে। প্রিয় সন্তানের জন্য খাওয়া-পড়ার পাশাপাশি তাদের ভালবাসার দরকার ছিল, সঙ্গ দেওয়ার দরকার ছিল। দিয়েছেন কি সেই ভালবাসা, সাহচর্য? দেননি। ভেবেছেন, ওদের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢাললেই হলো। ওরা এমনিতেই গাছের মতো তরতর করে বড় হয়ে যাবে। গাছেরও তো ন্যূনতম পরিচর্যা লাগে।
প্রিয় রাজনীতিক, নিজেদের সন্তানদের বিদেশে রেখে পড়ালেখা করিয়ে দেশে অশান্তির দাবা খেলা খেলেন আপনি। ভাবছেন এই আগুন আপনার ঘরে লাগবে না? নগর পুড়লে দেবালয় কিন্তু এড়ায় না। নিজে ইয়াবা তৈরির কারখানা করেন, আমদানি করেন। সন্তানদের কি সেই নীল বিষ থেকে নিরাপদে রাখতে পারবেন?
প্রিয় জনগণ, দেশ ঠিক করার আগে নিজেকে ঠিক করার দরকার ছিল। করেছেন কি? দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল আপনার। পালন করেছেন কি? দেশকে ভালবাসার দরকার ছিল। বেসেছেন কি? বাসলে তো দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা আজ দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে, রিকসা চালিয়ে জীবন কাটাতো না। বিনা চিকিৎসায় মারা যেতো না।[ads1]
প্রিয় রাষ্ট্রপরিচালকরা, ভ্রষ্টতা থেকে সরে আসুন। সমাজ একটি সিস্টেম। তাকে সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসুন। এ সময়ের তরুনদের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ নেই। কেনো নেই, তা তলিয়ে দেখুন। তারা সুন্দর পরিবেশ চায়। ঠেলাঠেলি চায় না। রাষ্ট্র একটি পরিবারের মতো; এখানে কলহ তৈরি হলে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যদের ওপর তার প্রভাব পড়ে বেশি। এই তরুণরা হলো সেই কনিষ্ঠ অথচ সম্ভাবনাময় সদস্য। তাদেরকে কেউ বিপথে নিয়ে গেলে বিপদে শুধু ওরাই পড়বে না, আপনারাও পড়বেন।
মাননীয় সরকার প্রধান, রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালনার শীর্ষস্থানে থাকার কারণে তৃণমূল সমাজের অনেক তথ্যই আপনার কাছে পৌঁছায় না। গণমাধ্যমের মাধ্যমে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হয় না। কারণ যারা গণমাধ্যমের নেতৃত্বে বা সিনিয়র, তারা একেকজন তোষামোদকারী। তারা আপনাকে ঘিরে রাখে। তাদের লেখাতে সমাজের আসল চিত্র উঠে আসে না। আপনাকে বসতে হবে তারুণ্যের সাথে। তারা কি বলতে চায়, শুনতে হবে। যদি দেশের কল্যাণ চান। আর যদি ভাবেন, ক্ষমতাই দীর্ঘায়িত করবেন, অমরত্বকে নয়, তাহলে আর কোনো কথা নেই।
অনেকে বলতে পারেন, ফ্রান্স-অ্যামেরিকার মতো দেশেও তো এ রকম হামলা হচ্ছে। হ্যাঁ, তাদেরও সমস্যা আছে। আমাদের সমস্যা শিক্ষা, দুর্নীতি, সিস্টেমহীনতা ইত্যাদি। আর ওদের সমস্যা বিশ্বমোড়ল হওয়া, অন্যায়ভাবে নানা দেশে গণতন্ত্র রফতানির জন্য অন্যায্য হামলা চালাতে যাওয়ার মতো জটিল সমস্যা। ওদের সমস্যাগুলোর চেয়ে আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান অপেক্ষাকৃত সহজ। আমাদের আছে শান্তির যৌথপরিবার। যেটা পশ্চিমা বিশ্বে অনুপস্থিত।[ads2]
তাই সবাই সচেতন হোন। সময় থাকতে সবাইকে নিয়ে বসুন। সরকারিভাবে সব দল নিয়ে, সামাজিকভাবে সমাজের মুরুব্বিদের নিয়ে, পারিবারিকভাবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। দেখবেন সমস্যা কমে আসছে। যদি ভাবেন, একাই সবকিছু করে ফেলবেন, তাহলে দুভোর্গ-দুর্যোগ শুধু বাড়বেই। এ সমস্যা তখন সমাধানের বাইরে চলে যাবে। কারণ আপনি জেগে জেগে ঘুমালে, কেউ আপনাকে জাগিয়ে দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে বসবে না। এই বিপথগামী তরুণরা যা করেছে, তা রীতিমত জঘন্য অপরাধ। এবং এর দায় আমরাও এড়াতে পারি না।
এখনই শোধরাবার ও জাগবার সময়, দেশকে, পরিবারকে, দেশের জনগণকে। নইলে আর নয়।
লুৎফর রহমান হিমেল : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।