তখন কি আমরা কিছুটা কম মুসলমান ছিলাম?

0

Afsana Begum1আফসানা বেগম :

‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা যখন আমার নিজস্ব অভিধানে ছিল না, তখনকার কথা বলছি।[ads1]

দিনাজপুর এমন এক শহর ছিল যেখানে দু-তিনটা মুসলিম বাড়ির পরেই ছিল একটি হিন্দু বাড়ি। স্কুলে কোনো কোনো ক্লাসে প্রায় অর্ধেক ছিল হিন্দু মেয়ে। দিনের পর দিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে আমরা কেউ কারো ধর্মকে আলাদা করে উঁচু তাকে উঠিয়ে রাখতে শিখিনী। তাই অবলীলায় সবাই সবার উৎসবে অংশ নিতাম; পারিবারিকভাবেই যেতাম। আমাদের ঈদের লুকিয়ে রাখা জামা আর শবেবরাতের হালুয়া নিয়ে তাদের যেমন কৌতূহল ছিল, পাড়ায় পাড়ায় পূজার মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে তাদের সঙ্গে নাচগান করা আমাদের জন্যও ছিল স্বাভাবিক। ঈদের সারাটা দিন তাদের যেমন বেড়ানোতে ক্লান্তি ছিল না, পাড়ার মণ্ডপ সাজানোর সময়ে প্রতিদিন সেখানে ঢু মারতে আমরাও ভুলতাম না। আমাদের ইফতারের পিঁয়াজু-ছোলা তাদের কাছে যেমন মুখরোচক লাগত, তাদের পূজোর নাড়ু আর দই-চিড়ায় অমৃতের স্বাদ পেতাম আমরা। রাতে মসজিদের মাইকে তারাবীহর নামাজের দোয়া কি তেলাওয়াত, কখনো আবার মন্দির থেকে ভেসে আসা ঢোলের বাড়ি আর মন্দিরার টুংটাং কিংবা শাঁখের বোঁ বোঁ শব্দ আমাদের রাতগুলো ভরে রাখত। আচ্ছা, তখন কি আমরা মুসলমান কিছুটা কম ছিলাম?

সরকারি স্কুলে নামাজের ঘর ছিল। টিফিন পিরিয়ডে আমরা জোহরের নামাজ পড়তে যেতাম। বাইরে বারান্দায় হিন্দু বন্ধু অপেক্ষা করত কখনো, বলত, ‘বলছিলাম যে তোকে, আমার জন্য ওই দোয়াটা করছিস তো?’ স্কুলে আয়োজন করে সরস্বতী পুজো হতো। আমরা সাজগোজ করে যেতাম সেদিন। খুব খাওয়াদাওয়া হতো। প্রার্থনার সময়ে সরস্বতীর পায়ের কাছে স্তূপ করে বই রাখা হতো। ভীতিকর ভূগোল বইটা হাতে দিয়ে বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘তোর সরস্বতীর পায়ের কাছে রেখে বলিস, ভূগোলে যেন আমার লেটার মিস না হয়।’ আচ্ছা, আমরা কি সত্যিই তখন খাঁটি মুসলমান ছিলাম না?[ads2]

সেই হিন্দু আর মুসলমান সবসমেত প্রাইমারিতে আমরা পড়তাম খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে। মাথায় জোর দিয়েও মনে করতে পারি না, আমাদের খ্রিষ্টান সিস্টার আর দিদিমণিরা কোনোদিন কারো ধর্মের চেয়ে কারো ধর্মকে মহান দেখানোর কিঞ্চিত চেষ্টা করেছেন। কেউ আমাদের আদেশ করেননি, নিজের খুশিতে আমরা স্কুলে লাফালাফি করে ক্রিসমাস-ট্রি সাজিয়েছি। ক্লাসের পরে কোনোদিন স্কুলের পেছনের অংশে চলে যেতাম, যেখানে সাদা ধবধবে শূকর পালন করা হতো। চঞ্চল বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা ছিল খুব মজার। ঘরে আমরা নিঃশব্দে যে যার ধর্ম পালন করতাম, তাই শূকরছানা ফেলে বিকেলে বাসায় ফিরে গোসল-অজু সেরে হুজুরের কাছে কোরানশরিফ পড়তে বসে গেছি। যে বিদ্যা কোনোদিন বুঝতে হয়নি, কেবল শুদ্ধ উচ্চারণে পড়ে যেতে হয়েছে, তা নিয়ে ছোট্ট মনে কোনো প্রশ্ন আসেনি। প্রশ্ন এ নিয়েও আসেনি যে কেন ক্লাসসুদ্ধ প্রার্থনার জন্য কোনোদিন আমাদের চার্চে নিয়ে যাওয়া হতো। অনেক উঁচু ছাদ আর চওড়া দেয়ালের শীতল হলরুমটা প্রশান্তিতে ঠাসা থাকত। বেঞ্চে বসে প্রত্যেক টেবিলে রাখা মোটা মোটা সাদা মোমবাতির জ্বলে জ্বলে গলে যাওয়া দেখলে অদ্ভুত এক ত্যাগের অনুভূতি হতো। সেখানে ফাদার কোনোদিন আমাদের মুখ দিয়ে ‘যীশু ঈশ্বরের পুত্র’ জাতীয় কিছু বলানোর চেষ্টা করেননি, বরং প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে এক মুসলমান কবি নজরুলের ‘দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য, হে উদারনাথ, দাও প্রাণ’ এবং এক হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথের ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে’ সমবেত গাইয়েছেন। গানের বাণী যখন উঁচু ছাদে গমগম করত, কোণের দিকের জালে ঘেরা কনফেস চেম্বারের দিকে তাকিয়ে আমি তার আগের কয়েকদিনে বলা মিথ্যেটিথ্যের জন্য চোখ বুজে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতাম। সেই ছোট্ট মনও তো জেনে গিয়েছিল যে সমস্ত প্রার্থনা একজন সৃষ্টিকর্তার দিকেই ধাবিত, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনার বিষয় নয়, তবে আজ জ্ঞানী-অজ্ঞানী কেউ তা মানতে চাইছেন না কেন! তখন কি তবে আমরা ঠিকঠাক মুসলমান ছিলাম না?[ads1]

ইতিহাসের হাতে এই সমস্ত দিয়ে আজ ২৫-৩০ বছর পরে এসে দাঁড়িয়েছি। আজ যখন রাষ্ট্রধর্মের লেবেল লাগানো জরুরি, আমরা ছাড়া বাকি সবার পরিচয় যখন হয় সংখ্যা দিয়ে, তারপরেও আমাদের কীসের ভয়? আমরা কি এখনো পুরোপুরি মুসলমান হতে পারিনি? ধর্মযাজককে হুমকি, হিন্দু পুরোহিতকে কুপিয়ে হত্যা, ধর্মীয়ভাবে অস্ত্র হাতে নিতে অপারগ ভিক্ষুকে অস্ত্রের আঘাতে হত্যা, অন্য ধর্মের মেয়েদের উলঙ্গ করে পেটানো কিংবা কৌশলে ধর্ষণ… অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কতকিছুই না করছি আমরা! এতকিছুর পরেও শুধু একটা সংশয় থেকে যায়, আমরা যথেষ্ট মুসলমান হতে পারলাম তো?[ads2]

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More