শ্রীলংকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ইস্তাম্বুলের বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন

0

Islamic Sq[ads1]ড. মোঃ নূরুল আমিন: গত দুই সপ্তাহ পাঠকদের সামনে হাজির হতে পারিনি বলে আন্তরিকভাবে আমি দুঃখিত। এই সময়ে কিছু মানবিক কারণ প্রত্যক্ষ করার জন্য আমাকে শ্রীলংকা যেতে হয়েছিল। পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন যে, মে মাসের প্রথম দিকে ভয়ঙ্কর ভূমিধসে শ্রীলংকার বিভিন্ন এলাকার মাটি চাপা পড়ে প্রায় ৭ হাজার লোক মারা গিয়েছিলেন। তারা পাহাড়ের ঢালে ঘরবাড়ি করে বসবাস করতেন। প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে পানির নিম্নমুখী স্রোতের তীব্রতায় পাহাড়ের মাটি ধসের ফলে মানুষসহ বাড়িঘর ও জনবসতি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। ফলে এই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। এর কয়েকদিন পরই দেশের উপকূলীয় এলাকায় বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে হাজার হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি প্রভৃতি ছেড়ে এবং হারিয়ে তারা কলম্বোসহ বিভিন্ন শহরের রাস্তায় এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ এই দুর্গত মানুষদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। মাথার উপর কোনো ছাদ ছাড়াই এদের অনেককে রাস্তায় এবং অন্যদের বাড়ির বারান্দায় ঘুমাতে আমি দেখেছি। এরা যে সবাই গরিব ছিলেন তা নয়।[ads1]

এদের মধ্যে অনেক বিত্তশালীও ছিলেন যাদের বিলাবসহুল বাড়িঘর পানির নিচে চলে গিয়েছিল। জীবনে অভাব দেখেননি এমন অনেক লোক সেখানে ছিলেন যারা কখনো ভাবেননি যে তাদের কখনো পরনির্ভরশীল হতে হবে অথবা ত্রাণ নিয়ে তাদের বাঁচতে হবে। ২২ মে বিকেলে মিহিন লংকায় কলম্বো পৌঁছে ইমিগ্রেশন শেষে বের হয়েই দেখি শরণদ্বীপ ত্রাণ ও উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের বিদেশ বিষয়ক সেক্রেটারি ড. মনোয়ার হোসেন অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। তিনি নিজে ড্রাইভ করে এয়ারপোর্ট থেকে কলম্বো শহরের কেন্দ্রস্থলে ৭৭, দেমাতাগোদা রোডে অবস্থিত ফাউন্ডেশন অফিসে আমাকে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে রেস্ট হাউজে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা উপদ্রুত এলাকা সফরে বেরুলাম। সেখানে দু’টি বিষয় আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একটি হচ্ছে মানুষের দুর্দশা। আমার মনে হয়েছে এই বিপর্যয়ের পেছনে মানুষেরও ভূমিকা ছিল। প্রথমত বিবেচনাহীন বৃক্ষ নিধন পাহাড়ের মাটি সংরক্ষণ ও তা শক্তভাবে ধরে রাখার ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়ায় ভূমি ধস প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে এবং বাড়িঘর ও জনবসতি এবং সাত সহস্রাধিক মানুষের জীবননাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে এবং এ বছর অনেকটা নিম্নমাত্রার এই ঘটনা ঘটেছে। এখানে পুনর্বাসন কাজ করতে গিয়ে আমরা যা করেছিলাম তা হচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে বসতবাড়ি নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আসলে তা বন্ধ হয়নি। ফলে এ বছর তা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছিল। সমতলে যদি পর্যাপ্ত জমি না থাকে অথবা থাকলেও সংশ্লিষ্ট পরিবারসমূহের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়া না হয় তাহলে ঝুঁকি নিয়েও মানুষ সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঘরবাড়ি নির্মাণে ব্রতী হয় এবং পুনঃপুনঃ দুর্যোগের শিকার হয়। দু’টি ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়েছে afforsetation এবং Retaining wall (যেখানে যেখানে প্রযোজ্য) নির্মাণ করে এবং শক্ত হাতে Defarestation বন্ধ করতে পারলে এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বন্ধ করা যেতে পারে। শ্রীলংকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনাকালে আমি এই বিপর্যয়ের উপর জোর দিয়েছিলাম। নদনদী ও খালবিল ভরাট হয়ে যাওয়া বন্যার পুনঃপৌণিকতা বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি ধারণ ক্ষমতা যখন তারা হারিয়ে ফেলে তখনই দু’কূল প্লাবিত পানি জনবসতির দিকে ধাবিত হয় এবং বাড়িঘর পানির নিচে চলে যায়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা যদি ঠিক থাকে এবং সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসকে বাধা দেয়ার মতো উপকূলে গাছপালা থাকে তাহলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কম হয়। এটা উভয় দেশের বেলায়ই প্রযোজ্য। এখনও বনায়নের ভূমিকা অপরিসীম।[ads1]

ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে শ্রীলংকার মানুষ সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রবণতা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলেই ত্রাণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রাতের বেলা কলম্বো শহরে মেলার আয়োজন দেখে আমি প্রথম হতবাক হয়েছিলাম। একদিকে দুঃখ কষ্ট অন্যদিকে সুখী মানুষের উল্লাস কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছিল। কিন্তু পরে শরণদ্বীপ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা আমার ভুল ভাঙ্গালেন- এটা ছিল ত্রাণমেলা। প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি সংগঠন এই মেলার ক্যাম্প খুলে টাকা পয়সা ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এখানে আমি সৌদি আরব ভিত্তিক ওয়ামী (WAMY) রাবিতাসহ অনেক আন্তর্জাতিক মুসলিম অমুসলিম এনজিওকে মেলায় অংশগ্রহণ করে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে উপদ্রুত এলাকায় নিয়ে যেতে দেখেছি।

দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় সম্পদ আহরণের এই প্রক্রিয়াটি বিদেশ নির্ভরতা পরিহারে একটি উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে আমার মনে হয়। এখানে মানবতার সেবায় সরকারের সঙ্গে বিরোধী দল অথবা এক রাজনৈতিক দলের সাথে অন্য রাজনৈতিক দলের কোনও বিরোধ আমার চোখে পড়েনি, আবার কাউকে চাঁদাবাজি অথবা বলপ্রয়োগে নিজের বা দলের প্রাধান্য বিস্তার করতেও দেখা যায়নি। সবাই সেখানে দেশপ্রেমিক।[ads1]

দুই.
২৪ মে শ্রীলংকা থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ২৫ মে ভোরে আতাতুর্ক বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। তুরস্কে যাবার উদ্দেশ্য ছিল Economic and Social Researches Centre বা ESAM নামক একটি গবেষণা সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত তাদের ২৫তম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে অংশগ্রহণ। তারা আমাকে তাতে অংশগ্রহণের জন্য দাওয়াত পাঠিয়েছিলেন। সম্মেলনটি ছিল ২৬ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত এবং সমাপ্তি অধিবেশনের পরে ইস্তাম্বুল বিজয় অনুষ্ঠান পালনের মধ্যদিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। বলাবাহুল্য, ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম সিপাহশালার সুলতান ফতেহ মাহমুদের হাতে বাইজেন্টাইন সম্রাটের (রোমের) পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা ইস্তাম্বুল বিজয় করেন। এই অনুষ্ঠানে অভ্যাগত অতিথিদের বিপুলভাবে উজ্জীবিত করেছে এবং মুসলমানদের শৌয্যবীর্যকে স্মরণ করে দিয়েছে।

ইসাম কংগ্রেসের এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, “Islamic World : Problems and Solution”. এতে ৫৬টি দেশের ২৯৫ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন এবং ইসলামী দুনিয়ার চলমান সমস্যাবলী ও তার সমাধান সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সম্মেলনে ইসলামী দুনিয়ার যে সকল মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে ছিল, মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহের অনৈক্য, পাশ্চাত্য নির্ভরশীলতা, অর্থনীতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা, মুসলিম উম্মাহর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী মুসলিম রাষ্ট্র ও ইসলামী আন্দোলনসমূহের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাব ও অনৈক্য, ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইন্টারনেটসহ সামাজিক মাধ্যমসমূহের অপব্যবহার ও অশ্লীলতার প্রসার, পরিচিতি সংকট, ইসলামী পুনর্জাগরণে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের বিরোধিতা এবং তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক আগ্রাসন, ইসলাম বিরোধী মিডিয়া প্রপাগা-া, মুসলিম দেশসমূহের আভ্যন্তরীণ সমস্যা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা, কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক প্রদত্ত মহিলাদের ন্যায্য অধিকার প্রদানে কোনো কোনো মুসলিম দেশের অনীহা ও সংখ্যালঘুদের প্রতি অবজ্ঞা এবং সর্বোপরি কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত পথে না চলাকে মুসলিম দুনিয়ার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তার সমাধানের বিষয়াবলী বিবেচনা করা হয়।[ads1]

ইস্তাম্বুলের ওয়াও আন্তর্জাতিক হোটেল ও কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত এ বছরের ইসাম কংগ্রেসের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যাপকহারে মহিলাদের অংশগ্রহণ যা আগে কখনো দেখা যায়নি। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নও মুসলিম শ্যালিকাও এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার বক্তব্যে তিনি ইসলাম গ্রহণের কারণ ও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন যে তিনি পাঁচ বছর ধরে ব্যাপক পড়াশোনা ও পর্যবেক্ষণ করে ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন যে, ইসলামে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও নারীদের মর্যাদা রক্ষার যে বিধান রাখা হয়েছে তা দুনিয়ার আর কোনও ধর্মে নেই। তিনি তার পূর্বধর্ম খৃস্ট ধর্মেরও ব্যাপক বিশ্লেষণ করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেন এবং ঘোষণা করেন যে পাশ্চাত্য জগতে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঐ সমাজের বিদ্যমান অবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করছেন তাদের সিংহভাগই হচ্ছেন নারী। তার ভাষায় পাশ্চাত্য নারীদের ভোগের সামগ্রী বানিয়েছে, পক্ষান্তরে ইসলাম নারীদের শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় আসীন করেছে। যারা মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেন তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন “আমার কাছে কুরআন ও হাদিস গ্রন্থ রয়েছে। আপনারা আসুন এই পবিত্র গ্রন্থসমূহের কোথায় এবং কিভাবে সন্ত্রাস উৎসাহিত করা হয়েছে তা দেখিয়ে দিন।

আমি জানি আপনারা নিশ্চয়ই তা পারবেন না, যদি না পারেন তাহলে মুখ বন্ধ করুন, যারা স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করেন তাদের সন্ত্রাসী বলা মানবতা বিরোধী অপরাধ।” পেশায় সাংবাদিক এই সম্মানিত মহিলা মিডিয়ার অপপ্রচার রোধে শক্তিশালী মুসলিম মিডিয়া গঠন ও যোগ্য লোক তৈরির ওপর জোর দেন। বলা বাহুল্য, তার দু’টি কিশোরী মেয়ে (১২ ও ১৪ বছর বয়সী) এবং স্বামীও তার সাথে এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মুসলিম মা বোনদের ইসলামের অনুশাসন মেনে চলা, সন্তানদের ইসলামী চরিত্র গঠনে সহায়তা এবং ইসলামী আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন যে, মায়েরা যদি ইসলামী আন্দোলনে অগ্রগামী হন তা হলে সমাজ ব্যবস্থার ইসলামীকরণ অবশ্যই ত্বরান্বিত হবে।[ads1]

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More