কারাগারে রমরমা ক্যান্টিন বাণিজ্য
ব্যবস্থা নিতে দুদকের সুপারিশ যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে * বিনামূল্যের খাবারের মান ভালো না হওয়ায় উচ্চমূল্যে ক্যান্টিনের খাবার কিনে খেতে বাধ্য হয় বন্দিরা
দেশের কারাগারগুলোতে চলছে অনুমোদনহীন রমরমা ক্যান্টিন বাণিজ্য। জেলে বন্দি আসামিদের জন্য প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার আয়েশি খাবার বেচাকেনায় খোদ কারা কর্মকর্তারাই জড়িত। ১৫ বছর ধরে চলছে এ ধরনের ব্যবসা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনে এমন তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কারা কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালে হালকা খাবারের অনুমতি নেওয়ার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছিল, ক্যান্টিনের আয় থেকে অর্ধেক ব্যয় হবে কারাবন্দিদের কল্যাণে। বাকিটা কারারক্ষীদের কল্যাণে।
কিন্তু দুদকের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ক্যান্টিনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি হচ্ছে। কারাগারে বেকারিজাতীয় খাবারের জন্য ক্যান্টিন পরিচালনার অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। সেই অনুমতির সূত্রে এখন যেভাবে কারা ক্যান্টিন পরিচালনা করা হচ্ছে, তা অনুমোদনহীন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
দুদকের একটি টিম সম্প্রতি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান চালায়। সেখানের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে দেশের অন্যান্য কারাগারের অবস্থা প্রায় একই উল্লেখ করে কমিশনে এ বিষয়ে সুপারিশ দাখিল করে।
সম্প্রতি দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ কারা ক্যান্টিন পরিচালনাসংক্রান্ত বেশ কিছু সুপারিশসহ কমিশনের কাছে ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাতে ক্যান্টিন ঘিরে কারা অভ্যন্তরে দুর্নীতি হচ্ছে জানিয়ে বলা হয়, কারাবিধির আলোকে কারাগারের অভ্যন্তরে ক্যান্টিন স্থাপন করা যায় কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। কিংবা দুর্নীতিমুক্তভাবে কারা ক্যান্টিন পরিচালনার জন্য যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন আছে কিনা, তা নিয়েও ভাবতে হবে।
একই সঙ্গে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে পত্র দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, দুদক যে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে তার কপি বা এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি আমরা এখনো পাইনি। তাই এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, সরকারের অনুমতি নিয়ে দেশের সব কারাগারে ক্যান্টিন চলছে।
ক্যান্টিনগুলোতে মূল্য তালিকা আছে। ওই তালিকার বাইরে খাবার বিক্রির সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বন্দিদের খাবারের সুবিধার জন্যই ক্যান্টিন চালু করা হয়েছে। তবে সব কারাগারের ক্যান্টিনে এক ধরনের খাবার পাওয়া যায় না। বন্দিদের চাহিদা অনুযায়ী, একেক কারাগারে একেক ধরনের খাবার পাওয়া যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেবল হালকা খাবারের জন্য ক্যান্টিনের অনুমতি নেওয়া হয়নি। বন্দিদের খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্যই ক্যান্টিনের অনুমতি নেওয়া হয়।
দেশে বর্তমানে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জনের। কিন্তু এসব কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বন্দি রাখা হয়েছে। আসামিদের একটা বড় অংশ বাইরে থেকে বা পরিবারের টাকায় কারাক্যান্টিন থেকে দামি খাবার খাওয়ার সুযোগ পান। অপরদিকে সাধারণ ও গরিব বন্দিরা সরকারি খাবারও ঠিকমতো পাচ্ছেন না।
দুদকের টিমের দাখিল করা প্রতিদেবনে বলা হয়, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের অনুসন্ধানকালে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সংগৃহীত রেকর্ডপত্র ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পর্যালোচনা করেন।
এতে দেখা যায়, ওই কারা ক্যান্টিনে ভাত ছাড়াও রান্না করা ভারী খাদ্যদ্রব্য, রুটি, মাছ, মাংস, ডিম, তরকারি ও অন্যান্য খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের পণ্য পাওয়া যায়, যা বন্দিরা নিজের অর্থে ক্রয় করে থাকেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানরত ১৩০০ বন্দির মধ্যে ৩০০-৪০০ বন্দি তাদের পরিবারের কাছ থেকে পাঠানো অর্থের বিনিময়ে কারা ক্যান্টিন থেকে রান্না করা ভারী খাবার কিনে খান।
এ বিষয়ে কয়েকজন বন্দি দুদক টিমকে জানান, কারাগারে বিনামূল্যে সরবরাহকৃত খাবার তেমন ভালো না। তাই পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে উচ্চমূল্যে ক্যান্টিনের খাবার কিনে খেতে বাধ্য হন তারা। বন্দিরা আরও জানান, অধিক মুনাফার আশায় কারা ক্যান্টিনের খাবার বেশি বিক্রি করা হয়।
এ ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহকৃত বিনামূল্যের খাবার নিম্নমানের করে সরবরাহ করে থাকে। যাতে বন্দিরা কারা ক্যান্টিনের খাবার কিনে খেতে বাধ্য হন। কিছু বন্দি জানান, পরিবার তাদের যে টাকা দেয়, সেই টাকা তাদের হাতে সরাসরি না দিয়ে পিসি বইয়ের মাধ্যমে হিসাব রাখা হয়। সেখানেও কিছু টাকা তছরুপ হয়।
দুদক টিম যে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুটি ক্যান্টিনের একটি ভেতরে, একটি বাইরে। ওই কারা ক্যান্টিন স্থাপনে কারাবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
এই ক্যান্টিনকে ঘিরে কারা অভ্যন্তরে দুর্নীতির আখড়া গড়ে উঠেছে। ক্যান্টিনে উচ্চ দামে সব ধরনের ভারী খাবার বন্দিদের মাঝে বিক্রয় করা হয়, যা কতটুকু বিধিসম্মত তা দেখা দরকার। এছাড়া ক্যান্টিনের কারণে সরকারিভাবে প্রদত্ত খাবার যথাযথভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কারা অধিদপ্তর ২০০৯ সালের ২২ এপ্রিল কারাগারে ক্যান্টিন পরিচালনার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সবকটি কারাগারে দুটি করে ক্যান্টিন রয়েছে। এই ক্যান্টিন থেকে বন্দিরা চা-শিঙাড়া-পুরি বা এজাতীয় হালকা খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ পান।
যশোরেও এই কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য সরকারের কাছে তখন আবেদন জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারাগারে বেকারিজাতীয় খাবারের জন্য ক্যান্টিন পরিচালনার অনুমতি দেয়।
কারাগারে এ ধরনের অনুমোদনহীন লাভজনক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার সুযোগ আছে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা হয় দুদকের প্রতিবেদনে। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিতে কমিশনের কাছে সুপারিশ করে কমিটি।
দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, কারাগারের ক্যান্টিনে অনিয়মের বিষয়ে করা প্রতিবেদনটি কমিশনে উপস্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
এক মহাপরিচালক জানান, কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে এ সংক্রান্ত সুপারিশসহ একটি পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
jugantor