শারমিনের চোখে ইজাজুলের পথচলা

0

sarminমানুষ তার প্রিয় মানুষটিকে ফুল,  চিঠি,  কার্ড অথবা গহনা দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ করে আসছে মানব সভ্যতার শুরু থেকে। আর এসব উপহারের মাধ্যমে প্রিয় মানুষটিকে জানিয়ে দেয় তার নিখাদ ভালোবাসার কথা। তাদেরই একজন শারমিন। সে কোন কৃত্রিম ভালোবাসা নয় তার সারাটা জীবন আর অকৃত্রিম ভালোবাসায় মুগ্ধ করে রেখেছে অন্ধ যুবক উজাজুল ইসলামকে। তার এই ভালোবাসার দৃষ্টান্তে মুগ্ধ প্রতিবেশীরাও। শারমিন তার ১২ বছরের নিখাদ ভালোবাসায় ছায়ার মতো আগলে রেখেছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইজাজুলকে।
যশোর কোতয়ালী থানার তেঘরিয়া গ্রামের ইকবাল হোসেনের মেয়ে শারমিন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌরসভাধীন বলিদাপাড়া গ্রামের মৃত বাবর আলীর ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইজাজুল ইসলাম। তাদের বিয়ে হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে। ডায়েরিতে লেখা ছিল সেটাও হারিয়ে গেছে। তবে বিয়ের সাল বলতে না পারলেও ইজাজুল জানায় চোখের দৃষ্টির হারানোর ৮ মাস পর কোন এক ২৪ নভেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল।
শারমিনের চোখের আলোয় এগিয়ে চলা ইজাজুলের ১২ বছরের দাম্পত্য জীবনে চাওয়া না পাওয়ার সংসারে ঘর আলো করে আসে জান্নাতুল ফেরদাউস নামে ৪ বছরের একটি মেয়ে আর আড়াই বছরের জিম নামের একটি ছেলে। ইজাজুল ইসলাম আর শারমিনের বাড়ির সাথেই রয়েছে একটি মুদি দোকানের ব্যবসা। দুই সন্তানের খুনসুটি, হাসি-কান্না, স্ত্রীর ভালোবাসা আর সামান্য মুদি দোকানের উপার্জিত আয় দিয়েই কেটে যাচ্ছে তাদের প্রতিটি দিন। এভাবেই জীবনের বাকি দিনগুলো কেটে যাবে এমনটিই দু’জনের প্রত্যাশা।
শারমিন জানায়,  প্রায় ১২ বছর আগের কথা। আমার বড় চাচা সুমন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমি তখন যশোর শহরে পল্লী ক্লিনিকে নার্সের কাজ করতাম। পেশা আর সম্পর্কের কারণে আমি সব সময় চাচার পাশে থাকতাম। তখন চাচাকে দেখতে অনেক মানুষ আসতো। সবাই কত সান্ত্বনার কথা বলতো। ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায় দৃষ্টি তাকিয়ে সবই শুনতো চাচা কিন্তু সে জানতো সবাই যা বলছে তা কেবলই অভিনয় আর মিথ্যা শান্তনা। সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে বুঝতে পেরে হাউ হাউ করে কাঁদতো। চাচা অবসর পেলেই আমাকে বার বার বলতো তোর যদি কখনো সুযোগ হয় কোন অসহায় মানুষের পাশে থাকবি। তখন চাচার অসহায়ত্বের কি করুণ আর্তনাদ প্রকাশ করতো তা চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। কিছু দিন পর চাচা মারা যায়। চাচার নির্দেশ আমার নারী হৃদয়টা সব সময় ব্যকুল করে তুলতো। মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার সেই অসহায় করুন মুখখানা রাতদিন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। চাচা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইজাজুলের কথা। আমি ইজাজুরের সঙ্গে কথা বলি। তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু বাধ সাধে আমার পরিবারে আপনজনেরা। সবার বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে চাচার নির্দেশ আর একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে অর্পিত দায়বদ্ধতা পালনের তাড়নায় আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ইজাজের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
শারমিন জানায়,  এখন আমার আর কোন কষ্ট নেই। ইজাজুলের মতো অনেক বড় মনের মানুষের জীবন সঙ্গী হতে পেরেছি।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইজাজুল ইসলাম জানায়,  আমার বয়স যখন ২০ বছর। চোখে ভাইরাস আক্রান্ত হয়। তখন ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে না পারায় চোখে কম দেখা শুরু হয়। এরপর পর দেশে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু দুই চোখ আর ভালো হয়নি। চিকিৎসকরা বলেছে আমার অন্ধ চোখ আর ভালো হবে না।
ইজাজুল আরো জানায়,  অন্ধ হলেও তার কোন দুঃখ নেই। কারণ শারমিনের মতো জীবন সঙ্গী পেয়েছি। শারমিনের চোখের আলোয় আমি পৃথিবী দেখি। আমাদের সংসারে রয়েছে দুটি সন্তান। সন্তানদের মধ্যে আমার অস্তিত্ব। শারমিন আমার পাশে না দাঁড়ালে আমার জীবন চোখের আলোর মতোই নিভে যেত।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে বলতেই ইজাজুল জানায়,  তাদের ভালোবাসার বিশেষ কোন দিনে নেই। প্রতিটি দিনই তাদের নিখাদ ভালোবাসার দিন। শারমিন তাকে আগলে রেখেছে শুধুই ভালবাসা দিয়েই। দু’জন যেন এভাবে মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থাকতে পারে তার জন্য দোয়া’ কামনা করেন সকলের কাছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More