ঢাকা: নিরাপত্তা ইস্যুতে দেশি-বিদেশি পরিদর্শন শেষে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক তৈরি পোশাক কারখানা। বেকার হচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। ক্রেতা কিংবা মালিক কোনো পক্ষই এদের ক্ষতিপূরণ দিতে আর দায়িত্ব নিতে নারাজ। কারখানা বন্ধের এ প্রক্রিয়াকে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছেন শ্রমিক নেতারা। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্ষতিপূরণ শ্রমিকের আইনগত প্রাপ্য। এ প্রাপ্য তাদের দিতেই হবে।
এদিকে ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে বেকার শ্রমিকদের মাঝে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, যেকোনো সময় গার্মেন্টস সেক্টর অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রমিকের নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ১২শ’ কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশ এ্যাকর্ড অন ফায়ার এ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি’ এবং ‘উত্তর আমেরিকান অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি’ পরিদর্শন করেছে ৮শ’টি কারখানা। শ্রমিকদের মাঝে এ সংগঠন দুটি ‘এ্যাকর্ড’ ও ‘এ্যালায়েন্স’ নামে পরিচিত।
এছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর টিম পরিদর্শন করেছে ৪শ’ কারখানা।
জানা গেছে, পরিদর্শন করা ১২শ’ কারখানার মধ্যে ভবনের দুর্বল কাঠামো, বিদ্যুৎ সেফটি ও অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকায় ২৪টি ভবনের ২১টি কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপভিত্তিক ১৫৫ ক্রেতার জোট এ্যাকর্ডের সুপারিশেই বন্ধ হয়েছে ১৯ টি। বাকি দুটি কারখানা বন্ধের সুপারিশ করেছে উত্তর আমেরিকার ২৬টি ক্রেতার জোট এ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি (এ্যালায়েন্স)।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর টিম ৪০০টি কারখানা পরিদর্শন করলেও তারা কোন কারখানা বন্ধের সুপারিশ করেনি। বরং কারখানার মালিকদের নানা বিষয় সংশোধনের জন্যে সময় দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে তার সবগুলোই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ের কারখানা।
এদিকে বিজিএমইএ’র তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, গত নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৬ মাসে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক। এছাড়া বন্ধ হওয়ার তালিকায় রয়েছে ৫০টির বেশি কারখানা। শ্রমিক সংগঠনের একাধিক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিদর্শনের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া গার্মেন্টসে এমন শ্রমিকও রয়েছেন, যারা ২০ বছর ধরে কাজ করছেন। অভিজ্ঞ এই শ্রমিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বিদায় করে দেয়া হয়েছে। দু/তিনটি কারখানায় তিনমাসের বেসিক বেতন দেয়া হলেও বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরির কথা ভাবছেন না কেউই।
যদিও শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ছাটাইকৃত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও শ্রম আইনের ২০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, মিরপুরে বন্ধ হওয়া টিউনিক ফ্যাশন, ন্যাচারাল উল ওয়্যার লি. ও ফোর উইংস নামে তিনটি কারখানায় শ্রমিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, এ্যাকর্ড-এ্যালায়েন্সের কারখানা পরিদর্শনের সুযোগ নিচ্ছে মালিকরা। এ প্রক্রিয়ায় আরো ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধের তালিকায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
রেডিমেট গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি লাভলী ইয়াসমিন বলেন, পশ্চিমারা এদেশে দীর্ঘ ৩০ বছর সস্তা শ্রমের সুযোগ নিয়েছে। কারখানার পরিদর্শনের জন্য এ্যাকর্ডের ১৫৫টি সিগনেটরি বায়ার রয়েছে। পরিদর্শনের জন্য প্রত্যেক বায়ার বছরে ছয় লাখ ডলার করে দিচ্ছে। এতে প্রায় ৭৭৫ লাখ ডলার তারা কারখানার পরিদর্শনের জন্য ব্যয় করছে। অথচ কারখানা বন্ধ হওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করলেও তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্সের কেউই।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, ‘কারখানা বন্ধ হওয়ার জন্য শ্রমিকরা দায়ী নয়। ক্ষতিপূরণ শ্রমিকের প্রাপ্য। ত্রুটির কারণে ক্রেতা বা সরকারের চাপে মালিক কারখানা বন্ধ করলে আইনগতভাবে ক্ষতিপূরণ তাদের দিতে হবে।’
একর্ডসহ সকল পরিদর্শন টিমের উদ্দেশ্যে এম এম আকাশের পরামর্শ, ‘হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। সবকিছুই ইতিবাচক উপায়ে সমাধান করা উচিত। অর্ডার বাতিল করতে হলে প্ল্যান ইন্টারভেনশন দিতে হবে। কারখানা বন্ধ করার আগে শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ দিয়ে কারখানা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আইনগতভাবে কারখানা বন্ধ করার অধিকার এ্যাকর্ডের নেই।’ বরং এ্যাকর্ডের বর্তমান ভূমিকা শ্রমিকের কল্যাণ বিরোধী বলে মনে করছেন দেশের এই অর্থনীতিবিদ।
অভিযোগ রয়েছে, মালিকরা একস্থানে কারখানা বন্ধ করে দিলেও অন্য স্থানে গিয়ে আবার কারখানা করছে। যদিও এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম।
তিনি আরো জানান, ‘বন্ধ হওয়া দুটি কারখানার শ্রমিকদের এক মাসের বেতন দেবে এ্যালায়েন্স। তবে এ্যাকর্ডের অধিনে বন্ধ হওয়া কোন কারখানার শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।’
উল্লেখ্য, রানা প্ল¬াজা ধসের পর বিশ্ব জুড়ে কারখানা নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এর ধারাবাহিকতায় এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মান উন্নয়নে কারখানা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়। জানা গেছে, দেশের সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মধ্যে এ্যালায়েন্স ৭০০ ও এ্যাকর্ড এক হাজার ৬১৯টি কারখানা পরিদর্শন করবে।
এ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি বাংলাদেশ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রবিন জানান, ভবনের নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও অগ্নি নিরাপত্তাসহ মোট তিনটি বিষয়ের উপর কারখানা পরিদর্শন করা হচ্ছে। একই ইস্যুতে পরিদর্শন করছে এ্যাকর্ড এবং এ্যাকশন প্ল্যানের অধিনে সরকার ও আইএলও। ভবন নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে বিল্ডিংয়ের অনুমোদন, অবকাঠামোগত নকশা, মাটি পরীক্ষা, ফ্লোরের ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি। ধারণ ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রতি স্কয়ার ফুটে সর্বোচ্চ ৪০ পাউন্ড হতে হবে। ইলেক্ট্রিক্যাল ড্রইং, ফায়ার ড্রইং এবং সিঙ্গেল লাইন ডায়াগ্রাম।
এছাড়াও অগ্নি নিরাপত্তা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে দেখা হয়, ফায়ার ডোর, হোসপাইপ, জুকিপাম্প, অটোস্প্রিঙ্কলার পদ্ধতি ইত্যাদি। ভবনের উচ্চতা ৬ তলার উপরে হলে স্প্রিঙ্কলার লাগানোর তাগিদ রয়েছে। ভবনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রডের গ্রেড কি? তা হাতুরি বা স্ক্যান করে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এদিকে বুয়েট ও এ্যালায়েন্স দেশীয় প্রকৌশলী দ্বারা কারখানা পরিদর্শন করলেও এ্যাকর্ড বিদেশি প্রকৌশলী দিয়ে কারখানা পরিদর্শন করাচ্ছে।
কাদের দিয়ে কারখানা পরিদর্শন করাচ্ছেন জানতে চাইলে এম রবিন জানান, ‘বিডি টেক্নোলজি, বিভি, ইকোওয়াই এন্টারপ্রাইজ, ইআইএমএস, শহিদুল্লাহ্ এ্যান্ড নিউ এসোসিয়েটস, সামেরা এবং উত্তোরণ ট্যাকনোলজিস নামে সাতটি ফার্ম তাদের হয়ে কারখানা পরিদর্শন করছে।’
এ বিষয়ে বিজিএমইএ-র সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মোট ১২শ’ কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৪টি ভবনের ২১টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি কারখানাই খারাপ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ অভিযোগ সত্যি হলে তো ৫০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। আসলে যতটা খারাপ বলা হচ্ছে- ততটা নয়।’
তিনি বলেন, ‘অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রপাতি লাগানো অনেক ব্যয়বহুল। শুধু স্প্রিঙ্কলার লাগাতে ১০ লাইনের একটি ছোট কারখানার ব্যয় হবে তিন থেকে চার কোটি টাকা। ২০ থেকে ২৫ লাইনের কারখানা হলে সাত থেকে আট কোটি টাকা খরচ হবে। তার পরেও অনেক মালিক অর্ডার বাতিলের ভয়ে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করেছেন।