তৈরি পোশাক খাতে ১৬ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। কার্যাদেশ পাওয়া থেকে শুরু করে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায় পর্যন্ত এ দুর্নীতি আর অনিয়ম হয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকেন কারখানার মালিক, মার্চেন্ডাইজার ও বিদেশি ক্রেতারা। পণ্যের মান, পরিমাণ ও কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি ঘুষের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়া হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। টিআইবি মনে করে, সুশাসন ও জবাবদিহিবিহীন এ পরিবেশে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য চাঁদাবাজি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
টিআইবি বলছে, তৈরি পোশাক খাতের সরবরাহব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। উৎপাদন কারখানা, ক্রেতা, নিরীক্ষকসহ অংশীজনের মাঝে দুর্নীতির চর্চা বিদ্যমান। এসব দুর্নীতি কখনো জোর করে, আবার কখনো বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতামূলক। শ্রম ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ‘উপরি’ দিলেই নিয়মভঙ্গের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে টিআইবি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জার্মানি চ্যাপ্টারের সহায়তার এ গবেষণাটি করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবির গবেষণায় যে ১৬ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে কার্যাদেশ পর্যায়ে চার ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এগুলো হলো ক্রেতার নির্ধারিত কমপ্লায়েন্স চাহিদা সম্পর্কে সন্তোষজনক প্রতিবেদন পাওয়ার অভিপ্রায়ে কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষককে ঘুষ দেওয়া; কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য ছোট আকারের কারখানা কর্তৃপক্ষ মার্চেন্ডাইজারকে ঘুষ দেওয়া; কারখানার মালিকদের নকল কাগজপত্র তৈরি করা অথবা বিভিন্ন কাগজপত্র প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা এবং কারখানার মালিক বা সরবরাহকারী কর্তৃক ঘুষের বিনিময়ে ক্রেতা বা এর এজেন্টের ক্রয়ের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করা হয়, যাতে ওই কারখানার পছন্দ অনুযায়ী কার্যাদেশ পাওয়া যায়।
টিআইবি বলছে, উৎপাদন পর্যায়ে নয় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। যেমন নির্দিষ্ট অ্যাকসেসরিজ কারখানা থেকে তৈরি পোশাক কারখানাকে উপকরণ কেনার জন্য মার্চেন্ডাইজারের পক্ষ থেকে বাধ্য করা; প্রয়োজনের তুলনায় কারখানার বেশি উপকরণ আমদানি এবং বাড়তি উপকরণ খোলাবাজারে বিক্রি; কারখানার পক্ষ থেকে অবৈধভাবে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ভাঙানো; ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা এবং শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন; ক্রেতাদের পক্ষ থেকে চুক্তিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন চাহিদা পূরণে কারখানাকে বাধ্য করা; আবার কারখানাগুলো চুক্তিবহির্ভূতভাবে সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়া; নিরীক্ষককে তাঁদের প্রাপ্ত তথ্য গোপন করার জন্য কারখানার মালিকদের ঘুষ দেওয়া; ক্রেতাদের ইচ্ছেমতো কার্যাদেশ বাতিল করা এবং ক্রেতাদের পরিদর্শন কিংবা কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন পরিবর্তন করা।
সরবরাহ পর্যায়ে তিন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এগুলো হলো মানের ঘাটতি ও নিম্নমানের পণ্যের বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কারখানার পক্ষ থেকে মান নিয়ন্ত্রককে ঘুষ দেওয়া; কারখানার কাছে মান পরিদর্শকের নিয়মবহির্ভূত অর্থ দাবি এবং গন্তব্য দেশের বন্দর পরিদর্শনের সময় নিম্নস্তর মূল্য প্রদানের উদ্দেশ্যে ক্রেতার মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন।
সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ প্রতিবেদনটি নিয়ে আমরা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করব।’ তিনি বলেন, ‘সুশাসনের দায় আমাদের। মুনাফা স্বচ্ছ করার জন্য সুশাসন দরকার।’ তাঁর মতে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর কারখানার মালিকদের চাপ দিয়ে ত্বরিত মুনাফা করার প্রবণতা বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিনিয়র কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শাহজাদা এম আকরাম ও সহকারী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক নাজমুল হুদা।
২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত গবেষণাটি করা হয়। বিদেশি ক্রেতা, বায়িং হাউস, কারখানার মালিক, শ্রমিক, কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষকসহ ৭০টি অংশীজন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়।
Prev Post