এক মাসে কর্মসংস্থান কমেছে ১৯ শতাংশ ; বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৮২ ভাগ
বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না, বরং দিন দিন তা যেন ক্রমান্বয়ে আরো জটিল হয়ে উঠছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার কমিয়ে আনা হয়েছে। ব্যাংকেও বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে। এর পরও বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। নতুন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করতে অর্থের জন্য ব্যাংকে আসছেন না। যেন সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে।
কথাগুলো বলেছেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, বিনিয়োগ করতে না পারায় ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যয় কমছে না। বরং মূল্যস্ফীতি বাড়ার সাথে সাথে ব্যয়ও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না হলে সামনে অর্থনীতির জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করছে বলে ওই এমডি মনে করেন।
বিনিয়োগ বোর্ডের সবশেষ পরিসংখ্যান মতে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৮২ শতাংশের ওপরে, আর সামগ্রিক কর্মসংস্থান কমেছে ১৯ শতাংশ। গত আগস্ট মাসের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ শতাংশ, যা জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির হিসাবে প্রকৃতপক্ষে ঋণাত্মক। কেননা, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ, আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশ। এ দুই মিলে হিসাব করলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে যায়।
কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না এ বিষয়ে উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা প্রায় অভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। উদ্যোক্তারা বলছেন, হরতাল অবরোধের মতো রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সঙ্কট রয়েছে। তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতে ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ, বিনিয়োগকারীরা চান সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল অনেকটা একতরফা। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা চলমান পরিস্থিতিতে ভরসা পাচ্ছেন না। আর সেই সাথে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কটতো রয়েছেই। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে।
বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাব মতে, এক মাসের ব্যবধানে স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে কর্মসংস্থান অস্বাভাবিক হারে নেমে গেছে। জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ২৬ শতাংশ। গত জুলাইয়ে স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে ১৯ হাজার ৮৭৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছিল। কিন্তু আগস্টে তা কমে নেমেছে ১৪ হাজার ৭৮৯ জনে। এক মাসে স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় পাঁচ হাজার।
অনুরূপভাবে শতভাগ বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগের নিবন্ধন ও বিনিয়োগ কমে গেছে। গত জুলাইয়ে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধিত বিনিয়োগ ছিল ১২টি, গত আগস্টে তা নেমেছে পাঁচটিতে। তেমনিভাবে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ জুলাইতে ছিল ১১১৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ ১৪ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার। আগস্টে তা নেমেছে মাত্র আড়াই কোটি ডলারে, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২০৩ কোটি টাকা। দেশী-বিদেশী মিলে সার্বিক কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় চার হাজার জনে। গত জুলাইয়ে সার্বিক কর্মসংস্থান হয়েছিল ২০ হাজার ৬৮৩ জন, আগস্টে তা নেমেছে ১৬ হাজার ৭২০ জনে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কে খান বলেছেন, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা কোনো বিনিয়োগ করছেন না। তিনি জানান, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে কখন কী হয়। বিনিয়োগ না হওয়ার এটা হলো প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। মানুষ কোথাও নিরাপদে নেই। ডিপ্লোমেটিক এরিয়াতেও দিনদুপুরে ছিনতাই হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট তো আগে থেকেই রয়েছে। সব মিলিয়েই বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। তিনি বলেন, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। জাপান চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। তারা বাংলাদেশকে বিনিয়োগে প্রাধান্য দিচ্ছে। আরো অনেক দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে। দেশ ও জাতীয় অর্থনীতিকে বিবেচনায় নিয়ে এ সময়টিকে কাজে লাগানোর জন্য রাজনীতিবিদদের সমাঝোতা চান এ উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, দেশে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ লোক কর্মসংস্থানে নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে। তাদের জন্য বর্ধিতহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশে সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মুর্শেদী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এখনো মানুষের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে। কখন কী হয় এ আশঙ্কা থেকে বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অনেকেই লোকসান দিতে দিতে বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে সুদের হার কমে গেলেও এবং হরতাল অবরোধ না থাকার পরেও বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। আর বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হলো, দেশীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগমুখী না হলে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে বা।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ের মতো ব্যাংকিং খাতের এমন দুরবস্থা অতীতে কখনো হয়নি। বিনিয়োগ মন্দা চলছে। ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করছেন। কেউবা খেলাপি ঋণ কমাতে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করছেন।
এ দিকে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে। আর এর পাশাপাশি ঋণের সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে। আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় আমানতকারীরা বেশি মুনাফার আসায় সঞ্চয়পত্রসহ অন্য খাতে বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুনে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ১৬৮০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪৪ গুণ। এক দিকে আমানত কমলেও বিনিয়োগ স্থবিরতার মাঝে ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়ে চলছে। বর্তমানে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ব্যাংকিং খাতে, যদিও এর বেশির ভাগই সরকারের কোষাগারে ঋণ আকারে আটকে রয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এতে সঙ্কট বাড়বে ব্যাংকিং খাতে, যা পুরো অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।