মৌলভীবাজার: দেশের রাজনৈতিক অস্তিরতা ও হরতাল অবরোধের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে চা শিল্পাঞ্চল ও পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলার পর্যটনের স্থানগুলি। শীত মৌসুম শুরু হলেও পর্যটকের আনাগোনা কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে।
গত বছর একই সময়ে মৌলভীবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড় লেগে থাকতো। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য গত একমাস ধরে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সব মোটেল-হোটেল, রেস্টুহাউস ও গেস্টহাউসগুলি খালি রয়েছে।
বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্ট মালিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের এই সময়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পর্যটক সমাগমে মুখরিত ছিল। বিপুল সংখ্যক পর্যটকের পদভারে মুখরিত থাকতো জাতীয় উদ্যান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি পর্যটন স্থানে কিশোর-কিশোরী, প্রৌঢ়সহ সব বয়সী পর্যটক ভিড় করতেন।
প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সবুজ-শ্যামলের সমারোহ চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল। এখানে শুধু চা-বাগানের ছড়াছড়িই নয়, রয়েছে সিলেট অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহৎতম হাওর ‘হাইল হাওর’।. সিলেট অঞ্চলের সর্বমহলে সুপরিচিত শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, কুরমা জলপ্রপাত, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বাইক্কা বিল, চা গবেষণা কেন্দ্র, অসংখ্য চা বাগান, টি রিসোর্ট, টি মিউজিয়াম দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করে। পর্যটকরাও এসব স্থানে এসে প্রাণখুলে প্রকৃতিকে উপভোগ করেন। বছরের এ সময়টাতে কোনো রিসোর্ট খালি থাকে না।
রিসোর্ট ও গেস্টহাউসের ম্যনেজার ও মালিকরা জানান, গত বছর অক্টোবর মাস থেকেই তাদের গেস্টহাউসে কোনো রুম খালি ছিল না। পর্যটকদের সামাল দিতে হোটেল ও গেস্টহাউসের মালিকদের হিমসিম খেতে হয়। কিন্তু এ বছর দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও অবরোধের কারণে কোনো পর্যটক নেই।
রিসোর্ট ও গেস্টহাউসগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ম্যনেজার ও স্টাফরা অলস সময় পার করছেন আলাপ আলোচনা করে। জেলার শ্রীমঙ্গলে এ পর্যটন ব্যবসাকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫টির বেশি গেস্টহাউস। পর্যটকদের আপ্যায়ন করতে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫টির বেশি রেস্টুরেন্ট। কোনো পর্যটক না থাকায় গত একমাস ধরে শ্রীমঙ্গলের হোটেল, রেস্টহাউস ও রিসোর্টগুলো খালি পড়ে আছে। আর এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেস্টুরেন্টগুলোর ব্যবসায় এ ভাটা পড়েছে। ফলে প্রতিদিন অন্তত গড়ে ৫ লাখের বেশি টাকা লোকসান হচ্ছে। কিন্তু মাস শেষে মালিকদের স্টাফদের বেতন, গ্যাস বিল, বিদুৎ বিল ইত্যাদি পরিশোধ করতে হচ্ছে ঠিকই।
বাংলাদেশ টি-বোর্ড পরিচালিত টি-রিসোর্ট অ্যান্ড টি মিউজিয়ামের এক্সিকিউটিভ অফিসার একেএম রফিকুল হক বাংলামেইলকে জানান, টি-রিসোর্টে ১৪টি কটেজ আছে। এরমধ্যে ৬টি ভিআইপি রুম আছে। কটেজ থেকে প্রতিদিন ভাড়া আদায় হয় ৭৫, ৯০০ টাকা। আর ভিআইপি রুম থেকে আদায় হয় ২০,১২৫ টাকা। ড্রাইভার থাকার কক্ষ থেকে আদায় হয় ২৭৬০ টাকা। টি-রিসোর্টে দৈনিক ভাড়া আদায় হয় ৯৮,৭৮৫ টাকা।
এ ছাড়া রিসোর্টে অতিথিদের খাবার বিল বাবদ দৈনিক ৩০ হাজার টাকা আদায় হয়। টি-রিসোর্টটি বছরে প্রতিদিন ১০০% বুকিং থাকে। কিন্তু গত একমাসে ধরে টি-রিসোর্টে কোনো পর্যটক নেই। স্টাফদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল বাবদ খরচ হয় প্রায় ৭ লাখ টাকা। নভেম্বর মাসে খরচ বাবদ রিসোর্টের নিজস্ব তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা ভর্তুকি দেন। সরকার অনেক রাজস্ব হারাচ্ছে।
গ্রিনভিউ গেস্ট হাউসের ম্যানেজার মো. হাসান আহমেদ বাংলামেইলের সঙ্গে আলাপকালে জানান, উনান গেস্টহাউসে মোট ২৯টি রুম আছে। এ থেকে প্রতিদিন ভাড়া আদায় হয় ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কোনো বর্ডার নেই। উক্ত গেস্টহাউসে স্টাফদের বেতন ও ইউটিলিটি বাবদ খরচ হয় প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার টাকা।
শ্রীমঙ্গলের বাংলা, চায়নিজ ও ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ কুটুম বাড়ির স্বত্বাধিকারী রাজর্ষি ধর রাজন জানান, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় হোটেল ব্যবসায় স্থবিরতা বিরাজ করছে। আমার হোটেলে অন্যান্য দিনগুলোতে বেশ ভালই কেনাবেচা হতো। এখন বেচাকেনা একেবারেই কমে গেছে কিন্তু হোটেলের প্রতিদিন স্টাফ ও ইউটিলিটি বাবদ খরচ দিয়ে প্রতিদিন লোকসান হচ্ছে ৮ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে আইপ্যাক প্রজেক্টের সাইট ফ্যাসিলেটর কর্মকর্তা কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, টানা অবরোধ, হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পর্যটকদের নিরাপত্তহীনতার কারণে লাউয়াছড়া এখন পর্যটক শূন্য। অবরোধ ও হরতালের কারণে নতুন কোনো পর্যটক আসেনি। লাউয়াছড়ায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার টাকা পর্যটকদের কাছ থেকে আয় হয়। কিন্তু গত ৩০ দিনে তেমন কোনো আয় হয়নি। শুধু তাই নয়, পর্যটক না আসার কারণে হোটেল-রিসোর্টগুলো আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। ফলে স্থবির হয়ে পড়ছে পর্যটন ভিত্তিক অর্থনীতি।
রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে আবার সচল হবে দেশের পর্যটনের অন্যতম এসব অঞ্চল। এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।