দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধরিগতি আর সংশ্লিষ্টদের অক্ষমতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প থেকে বৈদেশিক অর্থ প্রত্যাহারের হিড়িক পড়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানভিত্তিক সংস্থা জাইকার অর্থ প্রত্যাহারের ঘটনা সর্বাধিক। গত ৫ বছরে এভাবে ৪০৮ কোটি ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার প্রত্যাহার করেছে দাতারা, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। ফলে উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দাতাদের সঙ্গেও সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে এই বিশাল পরিমাণ অর্থ প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণে কোনো তদন্ত করেছে কিনা তা জানা যায়নি।
সূত্র মতে, সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০ প্রকল্প থেকে অর্থ ফেরত নেয় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। দাতা সংস্থাটির অভিযোগ ছিল, এসব প্রকল্পে দুর্র্নীতি হয়েছে। এরপর ২০১৫ সালের ৩০ জুন নাগাদ সংস্থাটির বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ওই ১০ প্রকল্পে দুর্নীতির অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হয় সরকার।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের বাতিল করা বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে- গতি না আসায় প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট সাপোর্ট প্রকল্প থেকে ৬৪০ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্প থেকে ৫৮৪ কোটি টাকা। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি ডলার ব্যয় করার পরও দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় বিশ্বব্যাংক। ২০০৫ সালে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল সরকার।
এছাড়া বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্প থেকে ৩২২ কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নেয় ডব্লিউএফপি। প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও সময়ক্ষেপণের কারণে জাপানের সংস্থা জাইকা টেলিকম খাত থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ফেরত নিয়েছে। চলতি অর্থবছরেই এডিবি কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের ২৫৩ কোটি টাকা, মাধ্যমিক শিক্ষা খাতের উন্নয়ন প্রকল্প (এসইএসডিপি) থেকে ৯৩ কোটি টাকা প্রত্যাহার করেছে। দাতা দেশ অস্ট্রেলিয়া তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৩) থেকে ২৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। প্রকল্পের ২১টি কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে অস্ট্রেলিয়া এ অর্থ প্রত্যাহার করে নেয় বলে ইআরডি সূত্র স্বীকার করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, দেশী হোক বা বিদেশী হোক উন্নয়নে অর্থ ব্যবহার করতে না পারা দুঃখজনক, যা উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু দাতা সংস্থাদের নানা জটিলতার কারণে সব সময় তাদের অর্থ ব্যবহার করা যায় না। এজন্য পাইপলাইনে বিশাল অংকের অর্থ জমা পড়েছে। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার কারণে অর্থ ব্যবহারে গতি আসছে না। তবে ক্রমেই মন্ত্রণালয়গুলোর অর্থ ব্যবহার করার সক্ষমতা বাড়ছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নানা কারণে দাতারা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়। এর মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর অদক্ষতা অন্যতম কারণ। আর তাই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, অনেক সময় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মসহ নানা কারণে বিভিন্ন প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণেও প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। যে কারণেই সহায়তা বাতিল হোক না কেন, তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেন, অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
জানতে চাইলে ইআরডি সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন বলেন, প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হলে তার অর্থ ফেরত দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে ইআরডির কিছু করার নেই। তিনি বলেন, ক্রয়নীতি অনুসরণ করা না হলে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি যেসব অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, সেসব যাচাই-বাছাই করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কোনো ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট কি পরিমাণ অর্থ প্রত্যাহার হয়েছে তা হালনাগাদ করা হয়নি। তবে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত বছরে সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রত্যাহার হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অর্থ ফেরতের পরিমাণ ১৩৪ কোটি ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১০ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। ওই বছর পদ্মা সেতুর আর্থিক সহায়তা বাতিলের কারণে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৯ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা বা ১২১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার অর্থ প্রত্যাহার করে নেয় দাতারা।
এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে দাতারা ১০৮ কোটি ৭৫ লাখ ৬৬ হাজার ডলার বা ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ফেরত গেছে। এছাড়া ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ডলার, তার আগের বছর প্রায় ১০ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইআরডির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম দাতারা ৩৯ কোটি ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ডলার সহায়তা প্রত্যাহার করেছিল। এরপর থেকেই প্রতি বছর কম-বেশি সহায়তা ফেরত দিতে হচ্ছে। এরপর ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে ৭২ কোটি ২৭ লাখ ৭১ হাজার ডলার সহায়তা প্রত্যাহার করা হয়। সবচেয়ে বেশি অঙ্কের ঋণচুক্তি বাতিল হয় ২০১১-১২ অর্থবছরে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৬১৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের সহায়তা বাতিল হয়েছে।
Next Post