এক. অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা অদ্ভুত একটা অস্ত্র বানিয়েছিল। নাম দিয়েছিল বুমেরাং। এটা এমন এক ধরনের অস্ত্র যা বাংলাদেশে বা আমেরিকায় বসে অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপের দিকে ছুড়ে মারলে তা গোটা বিশ্বে আঘাত করে আবার ফিরে আসবে। অস্ট্রেলিয়ানদের উদ্ভাবিত এ অস্ত্রের বদৌলতে আজ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছে। বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার তরফ থেকে। এ ঘটনার দুই দিন যেতে না যেতেই গুলশানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন এক বিদেশি নাগরিক। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত সব নাগরিকের চলাচলের ওপর সতর্কতা জারি করেছে ব্রিটিশ সরকার। যেখানে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ‘দেশে জঙ্গি, দেশে জঙ্গি’ বলে প্রচার করা হচ্ছে সেখানে আমাদের ছুড়ে দেওয়া বুমেরাং আমাদের হাতেই ফিরে আসাটা স্বাভাবিক নয় কি? মন্ত্রীরা এখন যতই বলুন না কেন দেশে জঙ্গির কোনো অস্তিত্ব নেই, জঙ্গি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তো শুরুই হয়ে গেল।
দুই. গত এক বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হাতে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে ক্রিকেট পরাশক্তি ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকে। বাকি ছিল অস্ট্রেলিয়া। বাঘের গর্জনে ক্যাঙ্গারুদের ভীত হওয়ার কথা প্রকাশ পেয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটারদের মিডিয়া ইন্টারভিউতে। সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ড সফরে দারুণভাবে ব্যর্থ হয় অস্ট্রেলিয়ানরা। ইতিমধ্যে দলের পাকা পাকা খেলোয়াড়রা অবসরে চলে গেছেন। আনাড়ি ক্যাঙ্গারুরা বাঘের দলের সঙ্গে মোকাবিলা করবে কোন সাহসে? তাই বাংলাওয়াশের ভয়ে তারা জঙ্গিতত্ত্ব আবিষ্কার করল। তাদের আসল ভয়টা কিন্তু হোয়াইটওয়াশের। নিরাপত্তার জুজু আর জঙ্গিতত্ত্ব্ব দেখিয়ে বিগ ব্রাদাররা আসলে নিজেদের ইজ্জত বাঁচানোর ইনিংসটাই খেলতে চাচ্ছে। মোক্ষম সুযোগটা আবার আমরাই তাদের দিয়ে দিলাম। তারা দেখেছে আমাদের যেন একটাই এজেন্ডা, জঙ্গি দমন। ‘বাংলাদেশ জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য’ এমন ভয়ানক আত্দঘাতী প্রচারণা যদি আমরা নিজেরাই করতে থাকি তাহলে অস্ট্রেলিয়া কেন, সোমালিয়া বা উগান্ডাও এদেশে আসতে সাহস করবে না।
তিন. কয়েক বছর ধরে পত্রিকার পাতা উল্টালেই জঙ্গি সন্দেহে জিহাদি বই ও লিফলেটসহ গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে নিত্যদিন। জঙ্গি সংগঠনকে অর্থায়নের অভিযোগ, এমনকি ‘মৌলবাদী অর্থনীতির’ তত্ত্ব পর্যন্ত দেখতে হয়েছে আমাদের। জঙ্গি সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড বোধ হয় গোটা কয়েক ডজনকে ধরতে পেরেছি আমরা। রাজপথ, টিভি এবং সংসদে প্রতিনিয়ত মন্ত্রী-এমপিরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে জঙ্গি বলেই সম্বোধন করেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতকে জঙ্গি সংগঠন বলে দোষারোপ করেন। সরকারি আরেক নেতা তো সরাসরিই বলেছেন মিসর, তিউনিশিয়া ও সিরিয়ায় জঙ্গি হামলার জন্য বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াই দায়ী।
চার. আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বড় তত্ত্ব ছিল ‘জঙ্গি কার্ড’। জর্জ বুশ গোটা বিশ্বে চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামের জঙ্গি কার্ড খেলে প্রতিপক্ষকে নিধন করেছেন। আমরাও বুশের মতো জঙ্গি কার্ড খেলে ভিন্নমতাবলম্বীদের গায়ে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে দিচ্ছি। ‘জিহাদি বই’ বা ‘জঙ্গি বই’ সমেত নাম না জানা অনেক জঙ্গিকে ধরেছি। দেশে যে কোনো অপরাধই ঘটুক না কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কষ্ট সহ্য করে সেগুলোর আর তদন্ত করার প্রয়োজন হয় না। কোনো না কোনো ইসলামী নামের জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট, ফেসবুক বা ইমেইলে সব অপরাধের দায় স্বীকার করে নেয়। কখনো এরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী। কখনো বা আবার আল-কায়েদার ভারতীয় শাখা। আমাদের তথ্যমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে জঙ্গিদের শেকড় উপড়ে ফেলার কথা বলে আসছেন। এভাবে জঙ্গি খেলা খেলতে খেলতে এবার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া চলে আসল। এতদিন যারা ‘জঙ্গি ধরা পড়ল, জঙ্গি ধরা পড়ল’ বলছিলেন নিরলস আজ তারা নিশ্চিতভাবে নিজেদের পরিশ্রমের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন। এদিকে মন্ত্রীরা বলছেন দেশে কোনো জঙ্গির অস্তিত্ব নেই। তাহলে যাদের এতদিন ধরে ধরা হলো তারা কারা?
পাঁচ. বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে কোনো বিদেশি খেলোয়াড়ের গায়ে কোনো অাঁচড় কখনো পড়েনি। বরং শচিন টেন্ডুলকার, শহীদ আফ্রিদি, ব্রেট লি বা ক্রিস গেইলদের ছবি বুকে নিয়ে লক্ষ কোটি দর্শক যেমন আনন্দে নেচেছে আবার তারা কষ্টেও সমানভাবে কেঁদেছে। সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করা তরুণদের হাতে কি করে এই সেলিব্রেটিদের জন্য হুমকি হয়? আসলে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো নিরাপত্তা ভীতিতে থাকা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে আস্থায় নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। আমাদের গায়ে জঙ্গি বা ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা লাগলে পরে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কূটকৌশল যাতে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে না নিয়ে যায় এ দায়িত্ব দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিতে হবে।
ছয়. বিশ্বে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে প্রায় সব মানুষের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, বর্ণ, গোষ্ঠী, চেহারা এক ও অভিন্ন। এদেশে সব ধর্মীয় দিবসে ছুটি থাকে। সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে উৎসব আয়োজনে আনন্দ উপভোগ করে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন নজির প্রায় বিরল। যারা প্রতিনিয়ত জঙ্গি জঙ্গি বলে চিৎকার করে তারাই আসলে বড় উগ্রপন্থি। আর প্রকারান্তরে বাস্তবতাটা হচ্ছে একেবারেই উল্টো। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ৫৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোন দেশে ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করা হয় তবে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের নামই সবার আগে স্থান পাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশের জঙ্গিদের বিষয়ে তাকে কী বলা হয়েছিল কে জানে, তিনি তার সাভার স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন বাতিল করে দিয়েছিলেন। আসলে যেসব পরগাছা রাজনীতিবিদ সারা জীবনেও পাঁচশ ভোটের বেশি পাননি তারাই ক্ষমতা আর পদবির লোভে জঙ্গিতত্ত্ব উদ্ভাবন করে দেশের বারোটা বাজাতে চলেছেন। জঙ্গি বলে হাসি তামাশা আর প্রতিপক্ষকে হেয় করাটা আমাদের কাছে সহনীয় হলেও বিদেশিরা কিন্তু বিষয়টিকে সিরিয়াসলিই দেখে। যদিও অনেকেই আবার চায় যে, বিদেশিরা বিষয়টিকে আসলেই সিরিয়াসলি দেখুক।
সাত. আমাদের দেশে যে একদম জঙ্গি নেই সেই দাবি করাটা ঠিক হবে না। তবে এটার ব্যাপ্তি কতটুকু তা আমাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে। তারা কি আসলেই যথেষ্ট বিপজ্জনক? আমাদের চৌকস আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি তাদের মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়? দেশ কি আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ? দেশের জাতীয় এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সব দল ও মতের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। রাজনৈতিক হীন স্বার্থে এর ব্যবহার কখনো কাম্য হতে পারে না। আজ অস্ট্রেলিয়া তার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে যে অবস্থা সৃষ্টি করল তাতে কি আমাদের নিজেদের কোনো দায় নেই? তাই তো কদিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় দেওয়া বক্তব্যে ব্রিটেনে অবস্থানরত বাংলাদেশের জঙ্গির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পুত্র ওয়াশিংটন টাইমসে বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে আমেরিকার সাহায্য চেয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। এবার অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের পথ ধরে আরও অনেক দেশ থেকেই হয়তো জঙ্গিতত্ত্বের বুমেরাং প্রভাবটি দেখা যাবে। এতে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না কারোরই। আমরা হয়তো ভুলে গেছি যে, এন্টিবায়োটিক রোগ সারালেও তার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিন্তু ঠিকই রেখে যায়।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন