দেশে বিজ্ঞান, কারিগরি ও কৃষি শিক্ষায় উচ্চস্তরে মাত্র ১১ ভাগ শিক্ষার্থীর পড়ার সুযোগ রয়েছে। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে গত ২০ বছরে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমেছে ১০ ভাগেরও বেশি। সরকার বিজ্ঞান, কারিগরি শিক্ষায় জোর দেয়ার কথা বললেও এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান চিত্র কেমন।
৩২ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার্থী সংখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যায়, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানে ৬৫ ভাগ, বাণিজ্যে ২২ ভাগ এবং বিজ্ঞান, কারিগরি ও কৃষিতে মাত্র ১১ ভাগ শিক্ষার্থীর পড়ার সুযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজ্ঞান শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসন সংখ্যা বৃদ্ধি না করায় শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ২ লাখ ২৬ হাজার পরীক্ষার্থী বিজ্ঞানে পাস করেছে। কিন্তু আসন সংখ্যা কম থাকায় সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পায়নি। এ কারণে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাদ্রাসা এবং অন্যান্য ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়া জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সকল বর্ষে ১৬ লাখ ৭৪ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থীর আসন রয়েছে। এর মধ্যে কলা ও মানবিক বিষয়ে পড়ছে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৭৮০ জন এবং সামাজিক বিজ্ঞানে ৪ লাখ ৬০ হাজার ২৯৬ জন। এছাড়া বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরি বিষয়ে ১ লাখ ৯১ হাজার ১০১ জন, বাণিজ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৯২৫ জন ও আইনে ৮ হাজার ২৪৮ জন পড়ছে।
এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কলা ও মানবিক বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর হার ৩৭ দশমিক ৪৩ ভাগ, সামাজিক বিজ্ঞানে ২৭ দশমিক ৪৯ ভাগ, বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরিতে ১১ দশমিক ৪১ ভাগ, বাণিজ্যে ২২ দশমিক ৬৩ ভাগ এবং আইনে দশমিক ৫০ ভাগ।
জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ৩২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিকে ২০ দশমিক ১৩ ভাগ, সামাজিক বিজ্ঞানে ১৫ দশমিক ৪৫ ভাগ, বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরী বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর শতকরা হার ৪৬ দশমিক ৪৭ ভাগ। আর বাণিজ্যে পড়ছে ১৩ দশমিক ১৫ ভাগ শিক্ষার্থী।
এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরি বিষয়ে মোট শিক্ষার্থী শতকরা ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ, কলা ও মানবিকে ৩০ দশমিক ৯১ ভাগ, সামাজিক বিজ্ঞানে ৩৩ দশমিক ৮৯ ভাগ ও বাণিজ্যে ২৭ দশমিক ৪০ ভাগ পড়ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চিকিত্সা, প্রকৌশল, কৃষি ও বিজ্ঞানে পড়ছে প্রায় ৯৮ হাজার, যা মোট শিক্ষার্থীর ৩৩ ভাগ। এছাড়া ব্যবসা প্রশাসনে পড়ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার, যা মোট শিক্ষার্থীর ৪২ ভাগের বেশি। এছাড়া কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও আইনে পড়ছে ৭৪ হাজার শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে গত ২০ বছরের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই সময়ে এসএসসি ও এইচএসসি এই দুটি পর্যায়ে ১০ ভাগ শিক্ষার্থী কমেছে। ১৯৯০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৯১ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ২৮ ভাগ। এছাড়া ৫২ ভাগ মানবিকের এবং ব্যবসা শিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রায় ২০ ভাগ। ২০১৩ সালে এসে দেখা যায়, এই সময়ে মোট পরীক্ষার্থী ৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৬৯ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ১৭ ভাগ, মানবিকের প্রায় ৪৯ ভাগ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থী ৩৪ ভাগ। ২৩ বছরে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ১০ ভাগের বেশি কমলেও বেড়েছে ব্যবসায় শিক্ষায়। এসএসসির ক্ষেত্রেও প্রায় একই চিত্র।
উচ্চ শিক্ষায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যোগ্য শিক্ষক না থাকায় অভিভাবকরা তার সন্তানকে বিজ্ঞানে পড়াতে রাজি নন। অভিভাবকদের ধারণা বিজ্ঞান পড়তে খরচ বেশি, বিজ্ঞানের সব বিষয় প্রাইভেট টিউশনি পড়তে হবে। যার অর্থ যোগাতে পারবে না। এ কারণে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা বিজ্ঞান পড়তে রাজি নয়। এছাড়া অষ্টম শ্রেণীতে ভাল ফল না করলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় পড়তে বাধ্য করে। তাদের বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ দেয় না।
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞান পড়তে হবে, গবেষণা ও উদ্ভাবন করতে হবে। তিনি বলেন, বিজ্ঞানের জন্য ল্যাবরেটরি দরকার। গবেষণার জন্য বাজেটও দরকার। কিন্তু আমাদের এই দুটিই কম। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রও কম থাকায় শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে আগ্রহী হচ্ছে না। তবে বিজ্ঞান না পড়লে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া যাবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।