জাবি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পুরনো হলেও নতুন খবর হচ্ছে কোটায় ভর্তিতে চলছে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য। তৎকালীন ভিসি আনোয়ারপন্থি প্রশাসনের সময় অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় একাধিক বিভাগে প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সেই কমিটি রিপোর্ট দেয়নি। অন্যদিকে ওই ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই একাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে ক্লাস করছে। তৎকালীন প্রশাসন পরিবর্তন হওয়ায় দায়ভার নিচ্ছে না নতুন প্রশাসন। এবার নতুন করে কোটায় ভর্তিতে বাণিজ্য চলছে। এ সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি মহল হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। সুযোগ হাতছাড়া করছেন না এক শ্রেণীর শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা করছে না ভর্তি কমিটি। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে চলছে দরকষাকষি। অন্যান্য ক্ষেত্রে অনিয়ম কিছুটা কম থাকলেও চরম পর্যায় পৌঁছেছে পোষ্য কোটায় ভর্তি। বিগত কয়েক বছর থেকেই চলছে এ অনিয়ম ও দুর্নীতি।
প্রশ্নপত্র ফাঁস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ সেশনের প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে ১ মার্চ। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ও ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এদিন একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। দিনের তৃতীয় শিফটের পরীক্ষায় নতুন কলা ভবনের ২১৭নং কক্ষ থেকে আব্দুল্লাহ আল নোমান নামের এক ভর্তিচ্ছুকে আটক করে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক গোলাম রব্বানী। এ সময় মোবাইলে এসএমএস-এর মাধ্যমে তাকে ‘এ’ সেটের উত্তর দেওয়া হয়। ও এম আর শিটে স্বাক্ষর করার সময় সব ঘর বলপেন দ্বারা পূরণ করা হলেও সেটকোড পেন্সিল দ্বারা পূরণ করা দেখে সন্দেহ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক গোলাম রব্বানী পরীক্ষার্থীর মোবাইল সিজ করলে মোবাইলে ‘এ’ সেট প্রশ্নের উত্তর পান।
আটককৃত নোমানের মাধ্যমে আরো তিনজনকে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলো- চুয়াডাঙ্গার ভর্তিচ্ছু শাহনাওয়াজ ও ইবরার। এছাড়া রায়হান আলী নামে ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকেও আটক করা হয়। রায়হান এসএমএস-এর মাধ্যমে নোমানকে প্রশ্নের উত্তর পাঠিয়েছে বলে নোমান জানিয়েছে। আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তি করানো হবে বলেও নোমানকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বলে সে জানায়।
অভিযুক্ত রায়হান জানায়, আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে একজনের সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছে। শাহেদ (সাহেব) নামের জাবির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের (৪২ ব্যাচ) এক ছাত্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। শাহেদ (সাহেব) তাকে যা করতে বলেছে সে তাই করেছে বলেও সে জানায়। রায়হানকে আটকের পূর্বে আবদুর রহমান নামের এক ছাত্রকে ধাওয়া দিয়েও আটক করতে পারেনি জাবির দুই সাংবাদিক।
আটকের বিষয়ে ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম রব্বানী জানান, ভর্তিচ্ছু ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষার রোলসহ সব ঘর বলপেন দ্বারা পূরণ করলেও সেটকোডের ঘর পেন্সিল দ্বারা পূরণ করায় সন্দেহ হলে তার মোবাইল জব্দ করা হয়। মোবাইলে ‘এ’ সেট প্রশ্নের উত্তরগুলোর এস এম এস পাওয়া যায়। ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী ‘বি’ সেট পেলেও পেন্সিল দিয়ে ঘর পূরণ করে পরে ‘এ’ সেট লেখার জন্য সেটকোডের ঘর পেন্সিল দ্বারা পূরণ করেছে। মোবাইলে পাঠানো উত্তরগুলো মিলে যাওয়ায় ফলাফল স্থগিত করার আহ্বান জানান অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। তবে ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন।
এ প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রক্টর ড. মুজিবুর রহমান বলেন, এসএমএস-এর উত্তর আর সেই সেট প্রশ্নের উত্তর সিংহভাগই মিলে গেছে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মূল হোতাকে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশাসনকে সকল বিষয়ে অবহিত করা হবে। এটা ভর্তি পরিচালনা কমিটি করবে। তবে পদত্যাগী সাবেক প্রক্টর মুজিবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আমি আর এখন প্রক্টর নই। কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা-১) মুহম্মদ আলী কিছু বলতে রাজি হননি।
নাতনীকে মেয়ে সাজিয়ে ভর্তি
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে নিয়মের তোয়াক্কা না করে নাতনীকে মেয়ে সাজিয়ে ভর্তি করার ঘটনা ঘটেছে। জানা যায়, সানজিদা পারভিন রুম্পা নামের এক শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের রাজমিস্ত্রি মো. আলীর নাতনী যাকে মেয়ে পরিচয়ে ওই বিভাগে ভর্তি করানো হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীর ফরম নম্বর-৪৫, ক্রমিক নম্বর-১৯ এবং ভর্তি পরীক্ষার রোল নম্বর-২০১১৪৩৭। এ ব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি মানস চৌধুরীকে পাওয়া যায়নি। অভিযুক্ত মো. আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
পাস নম্বরের শিথিলতা
পোষ্য কোটায় অন্যতম অনিয়মের স্থান হলো পাস নম্বরের শিথিলতা। প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা নিজেদের সুবিধার্থে পোষ্য কোটায় পাস নম্বর কমিয়ে সন্তানদের ভর্তির সুযোগ নিচ্ছেন। এ বছর প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্য কোটায় অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের অতিরিক্ত (গ্রেস মার্ক) ৩ নম্বর দিয়ে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে পোষ্য কোটায় অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ১ নম্বর দিয়ে ভর্তি করানো হয়। এর আগের বছর (২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ) অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে প্রায় ৭৮ জন অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের পরই পোষ্য কোটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শিক্ষকের সন্তানরা অকৃতকার্য হয় তাদের প্রয়োজনেই ডাকা হয় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির বিশেষ সভা। এ সভায় ওই সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা শিক্ষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাস নম্বর শিথিল করে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে এ সুযোগ সুবিধা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা। ভর্তি হতে না পারা শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পোষ্য কোটায় ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা করা হচ্ছে।
দু’লাখ টাকায় চুক্তি
‘যে প্রক্রিয়ায় ভর্তি করানো হবে সেটা একান্তই স্পেশাল। সেক্ষেত্রে দুই লাখ টাকাই লাগবে। কোনো কম হবে না। এক লাখ টাকা এই সপ্তার মধ্যেই দিতে হবে, কারণ এই প্রক্রিয়ায় আরো কিছু ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট আছে। তাদের দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার পর বাকি টাকা দিতে হবে।’
অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থীকে টাকা নিয়ে ভর্তির বিষয়ে কথাগুলো বলছিলেন রসায়ন বিভাগের কর্মচারী মো. শহীদুল ইসলাম। গোপনে ধারণকৃত এক কথোপকথনের ভিডিও চিত্রে আরো জানা যায়, তিনি এর আগেও দর্শন বিভাগসহ একাধিক বিভাগে জালিয়াতির মাধ্যমে একাধিক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করার কথা স্বীকার করেছেন। আর এই জালিয়াতির সঙ্গে একাধিক শিক্ষক জড়িত রয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’
অন্যদিকে কোটায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় সীমাহীন দুর্নীতিতে থেমে নেই ছাত্রলীগের তৎপরতা। শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষকদের সঙ্গে আঁতাত করে চালিয়ে যাচ্ছে ভর্তি বাণিজ্য। সংস্কৃতি ও খেলোয়াড় কোটাতেও রয়েছে দুর্নীতির সীমাহীন সুযোগ। গোপন সূত্রে জানা গেছে, এ কোটাগুলোতেও টাকার বিনিময়ে নকল সনদ দেখিয়ে ভর্তি হচ্ছেন অনেকে। যে সংঘবদ্ধ চক্র ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারাই বর্তমানে অবৈধভাবে বিভিন্ন কোটায় অযোগ্য শিক্ষার্থী ভর্তি করে অর্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। নাতনীকে মেয়ে সাজিয়ে ভর্তির ব্যাপারে ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী (শিক্ষা-১) বলেন, ১৫ বছরের বেশি সময় কেউ নিঃসন্তান থাকলে সে দত্তক নিয়ে তার সন্তানকে ভর্তি করতে পারবে। তবে ভর্তিকৃত ওই শিক্ষার্থীর ফাইলগুলো দেখতে হবে।
পাস নম্বর শিথিলের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির সদস্য ও উপ-উপাচার্য মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘এই পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছে। আমরা তো আর এক দিনে বাতিল করতে পারি না।’ – See more at: http://www.sheershanews.com/2014/06/07/40080#sthash.cIdAkbRl.dpuf