বাঙালির হাসির রাজা ভানু

0
32
সহশিল্পী ও বন্ধু উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘শখের চোর’, মীনা কুমারীর সঙ্গে ‘বন্দিস’ এবং সাবীত্রী দেবী ও বিকাশ রায়ের সঙ্গে ভানু বন্দোপাধ্যায়

ঢাকা: ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এসে বদলেই গেল দেশ অন্তপ্রাণ এক ‘সাম্যময়’ ছেলের জীবন। পরবর্তীতে ‘বাঙাল’ ভাষাকে নিজের শিল্প-জীবন দিয়ে খ্যাতির অসীম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। হাস্যকৌতুক শিল্পে নতুন এক ঘরানার জন্মও হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। মঞ্চ-চলচ্চিত্র-শ্রুতিনাট্য— স্বরক্ষেপণই জানিয়ে দিত তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। ৪ মার্চ প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বাংলামেইল পরিবারের শ্রদ্ধার্ঘ্য-

‘মাসিমা, মালপো খামু…!’ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যদি সেরা দশটি সংলাপের তালিকা কোনোদিন তৈরি করা হয়, তাহলে এই সংলাপটি নিশ্চিতভাবে তারমধ্যে স্থান পাবে। এই সেই ছবি, যেখান থেকে সূচনা হয়েছিল বাংলা ছবির এক সোনালী অধ্যায়। কিন্তু সে তো অন্য গল্প। আপাতত যার মুখ দিয়ে এই সংলাপ বেরিয়েছিল, তার কথা স্বল্প-পরিসরে বলা যাক। তিনি আমাদের সবার প্রিয় শ্রী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা চলচ্চিত্রের কমেডি কিং।

পোষাকী নাম ছিল সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। আর জন্মস্থান? এমন চোস্ত ভাষা যার, তিনি যে শতভাগ বাংলাদশি হবেন- তাতে আর সন্দেহ কি? অবশ্য তৎকালীন সময়ে এটা ছিল পূর্ববঙ্গ, বহু নামজাদা লেখক-শিল্পী-ডাক্তার-মোক্তার-আমলা-হাকিম, এমনকী পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্মস্থান বিক্রমপুর জেলার মুন্সীগঞ্জে। একই জেলায় ১৯২০ সালের ২৭শে অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন ভানু। ‘আইজ্ঞা হ’- বাংলাদেশি এই ছেলেই বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হাস্যকৌতুকের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন।

সেন্ট পোগোজ স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার। সেন্ট গ্রেগরি’স হাই স্কুল এবং জগন্নাথ কলেজে শিক্ষার পাট চুকিয়ে কলকাতায় গমন করেন ১৯৪১ সালে। আয়রন এন্ড স্টীল কোম্পানি নামে একটি সরকারি অফিসে যোগ দেন। তবে দেশভাগের বিশৃঙ্খল অবস্থাকেই তিনি বেছে নেন নিজের চাকরিজীবনের শৃংখলামুক্তির জন্য। শুরু করেন অভিনয়। ১৯৪৭ সালে ‘জাগরণ’ ছবির মাধ্যমে রূপালী পর্দায় অভিষেক ঘটে তার। নিয়তি দেবী মুচকি হেসেছিলেন, কারণ তার হাতেই যে লেখা হবে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের বিশাল এক অধ্যায়।

এরপর একে একে ‘অভিযোগ’, ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘বরযাত্রী’, ‘পাশের বাড়ি’ প্রভৃতি ছবিতে নিজেকে চলচ্চিত্র মহলে পরিচিত করে তোলেন ভানু। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। বলা যেতে পারে যে এই ছবির মাধ্যমেই দর্শক জনপ্রিয়তার প্রথম স্বাদ পান তিনি। এর পরের বছর মুক্তি পায় ‘ওরা থাকে ওধারে’। ঘটি-বাঙালের চিরন্তন বচসা নিয়ে নির্মিত এ ছবিতে অনবদ্য ভানু সমানভাবে উজ্জ্বল ছিলেন উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনের পাশে।


চিত্রগুপ্ত, নারদ, ইন্দ্র এবং দেবদেবীদের সঙ্গে ভানুর কথপোকথন শুধু কৌতুক নয়, ধর্মবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের শিকড়ে কুঠারাঘাত করে। স্বর্গের ঊর্বশীকে ‘হাম-হাম-গুড়ি-গুড়ি নাচ’ নাচ শেখানো সময় ভানুর দেহভঙ্গী ও অভিব্যক্তি বাংলা কমেডি ছবির ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।জহর রায়ের সঙ্গে ভানুর একটা অসম্ভব রসায়ন ছিল- তাদের কমিক টাইমিং, সংলাপ বলার ধরণ এবং দু’জনের মধ্যে সমঝোত এতটাই ছিল যে সেইসব ছবি যারা না দেখেছেন তাদের পক্ষে অনুধাবন করা শক্ত। অবশ্য ভানু-জহর জুটির ছবি দেখেননি, এরকম বাঙালি মনে হয় খুব বেশি নেই। ১৯৫৮ সালটি এই জুটির জন্য উল্লেখযোগ্য। ‘ভানু পেল লটারি’ এবং ‘যমালয়ে 21জীবন্ত মানুষ’- এই দুই ছবির মাধ্যমেই ভানু-জহরের জয়যাত্রা শুরু।

যার জন্য ছবির সাফল্য, তিনিই তো নায়ক। তবুও মূল নায়কের চরিত্রের আবদেন তো ভিন্ন। সেই মতে ১৯৫৯ সালে ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবির মাধ্যমে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ভানু। রুম গুহঠাকুরতার বিপরীতে তিনি প্রমাণ করে দেন, তিনি শুধুমাত্র কৌতুক অভিনেতাই নয়। দু’টি গানের পাশাপাশি ভানুর ঠোঁটের সোনায় বাঁধানো সংলাপ ‘আজ্ঞে আমার আসল নাম রমাপদ, কিন্তু বন্ধুরা পদ ছাড়া করেছে!’ কৌতুকপ্রিয় বাঙালির মুখে হাসি ফোটায় আজও। এছাড়া পিয়ানোকে টাইপরাইটার ভেবে ভানুর শিক্ষাদান পদ্ধতি কালজয়ী।

১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘৮০তে আসিও না’ ছবিটিতেও ভানু নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পুকুরে ডুব দিয়ে পুনর্যৌবন প্রাপ্ত হওয়া নিয়ে লোকজনের মধ্যে বিভ্রাট এবং বিতন্ডা খুবই উপভোগ্য। এখানে জহরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় ছিলেন। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিস প্রিয়ংবদা’ ছবিতে চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা সেজে অতুলনীয় অভিনয় করেন ভানু। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবির উল্লেখ ছাড়া অসমাপ্ত রয়ে যাবে ভানুর জীববকর্ম। এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। ভানু এবং জহর জুটির শ্রেষ্ঠ ছবি বলা যেতে পারে এ ছবিটিকে। এই জুটি প্রথম দৃশ্য থেকেই মাতিয়ে রাখে দর্শককে, একদম শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। চলচ্চিত্র ছাড়াও হাস্যকৌতুক রেকর্ডেও তিনি নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে গেছেন।

ভানুর শেষ ছবি ‘শোরগোল’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে। তার কিছুদিন পরে ৪ মার্চ অনন্তলোকের মহাযাত্রায় পাড়ি জমান ভানু বন্দোপাধ্যায়। আজীবন গম্ভীর মুখে সহজাত ভঙ্গিতে আপামর বাঙালি জাতিকে হাসিয়েছেন তিনি, শেষ যাত্রায় সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন হাসিমুখে।

তিন ছেলে মেয়ে গৌতম বন্দোপাধ্যায়, বাসবী ঘটক বন্দোপাধ্যায় ও পিনাকী বন্দোপাধ্যায় এবং অসংখ্য গুনগ্রাহী ভক্ত দর্শক আজও এই হাসির রাজার প্রয়াণ দিবস স্মরণ করে শ্রদ্ধায়। এখনো যখন বাঙালি শুধুই হাসতে চায়, কানে বাজে ভানুর অমর সংলাপ, ‘দ্রিমু য্রখন ত্রখন স্রবটাতেই দ্রিমু’।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More