যুব সমাজ নষ্ট করার ছবি জিরো ডিগ্রী

0

hqdefaultরুহি গোসল শেষে শরীরে শুধু তোয়ালে জড়িয়ে মাহফুজের সঙ্গে স্কাইপেতে কথা বলছে। মাহফুজ বলল- ‘একটু নামাও না।’ হলজুড়ে দর্শকের হৈ-হুল্লোড় শুনে বোঝা গেল, আরেকটু নামালেই তারা অপ্রত্যাশিত কিছু একটা দেখতে পাবেন। আসলে তারা আরও একটু বেশি প্রত্যাশা করছে। করবে নাই বা কেন? ইউটিউবে জিরো ডিগ্রী ছবির ট্রেইলারে বলা হয়েছিল Expect unexpected. এই প্রত্যাশা থেকেই কিছু সংখ্যক দর্শক হলে ছুটে গিয়েছিল ছবিটি দেখতে। তবে রুহি কী পেরেছিল দর্শকদের সেই প্রত্যাশা মেটাতে? সেই রহস্য আড়ালে থাক নীরারূপী রুহির তোয়ালেতে। বরং গল্পের কিছু অসংগতি তুলে ধরে ব্যাখ্যা করা যাক, পরিচালক অনিমেষ আইচ কতটুকু প্রত্যাশা মিটিয়েছেন দর্শকের।

‘রাতের বেলা বোরখা পরে ছুরি হাতে জয়া আহসান ব্যস্ত কাঁচা বাজারে তাড়া করছেন আরেকজনকে। বাজারের বাকি লোকদের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই, সবাই নিজেদের মতো বাজার সদাই করছেন। জয়া লোকটিকে খুন করলেন। লোকজন চারপাশে জমা হয়ে সেটির ভিডিও করতে লাগল। খুন শেষে জয়া লক্ষ্মী খুকির মতো ভিড় থেকে বের হয়ে গেলেন। লোকজন সরে জায়গাও দিল। তারও পরে দেখা গেল পুলিশ সেই খুন নিয়ে আলোচনা করছে। অথচ পুলিশ তো চাইলেই যারা ভিডিও করেছিল তাদের থেকে ফুটেজ নিতে পারত। এই ফেসবুকের জামানায় কেউ ওই ভিডিও শেয়ার দেয় নাই এটা বিশ্বাসযোগ্য না। হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন এত ‘ত্যানা প্যাঁচানো’ কেন? পুরো ছবিতে পরিচালক অযথাই কয়েকবার এই ত্যানা প্যাঁচিয়ে প্রত্যাশা তৈরি করেছিলেন। খুনের যে ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেটা ছবির শেষ ভাগ থেকে নেয়া। সাধারণত থ্রিলার ছবিতে বাড়তি রহস্যযোগ করার জন্য গল্পের শেষের দিকটা প্রথমে দেখানোর একটি ট্রেন্ড রয়েছে। গল্প বলার এ পদ্ধতিকে বলা হয় reverse chronology. কিন্তু জিরো ডিগ্রি ছবিতে প্রথমার্ধে গল্প বলার ভঙ্গি ছিল chronological মানে একজনের গল্প একদম প্রথম থেকেই শুরু করা। আর দ্বিতীয়ার্ধে ছিল প্যারালাল মানে কয়েকটি গল্প পাশাপাশি বর্ণনা করা। সেই সঙ্গে ছিল কোনো গল্পে অযথা বিশদ বর্ণনায় গিয়ে অসংগতিতে ঢুকে পড়া। এর ফলে থ্রিলার দাবি করা গল্পের গতি দ্বিতীয়ার্ধে একেবারেই পড়ে গেছে। আরেকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। প্রেমিকের সঙ্গে রুহির দ্বন্দ্ব দেখান হল। যদিও সিঙ্গাপুরে তারা বিয়ে করে আছে, নাকি লিভ টুগেদার করছে নাকি আলাদা আলাদা বাসায় আছে তা বলা হয়নি। জেমসের গান শুরু হতেই দর্শক করতালি দিয়ে উঠে এবং সেই গান চলাকালে রুহির সঙ্গে প্রেমিকের বিছানার দৃশ্য দেখানোতে বোঝা গেল তাদের ভেতরে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এদিকে মাহফুজ ফোন করে রুহিকে জানায় সে সিঙ্গাপুরে এসেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে তার ভয়েস ন্যারেশনে জানা যায়, সে রুহিকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে চায়। রুহি পালাতে চাইলে প্রেমিক তাকে বাধা দেয় এবং দু’জনের একটি ফাইনাল জাপ্টাজাপ্টি শেষে রুহি মুক্তি পায়। সে বাংলাদেশে এসে মাহফুজকে ফোন দিয়ে বলে, ‘আমি তোমার কাছে চলে এসেছি’। এর আগে দেখান হয় মাহফুজও সিঙ্গাপুর থেকে এসে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। কিন্তু তারা তো দেখা করলে সিঙ্গাপুরেই করতে পারত? তাহলে মাহফুজকেই বা সিঙ্গাপুরে নেয়ার কারণ কি? রুহি ও তার প্রেমিকের বিছানার দৃশ্য দেখে হলে বসা এক দর্শক বলে উঠলেন, ‘একের পর এক রেসলিং ম্যাচ দেখতে ভালোই লাগতাছে’। দর্শকের মন্তব্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে। পুরো ছবি জুড়ে গল্পের সঙ্গে রেসলিং করেছেন পরিচালক অনিমেষ আইচ নিজেই। ডব্লিউডব্লিউই রেসলিংয়ে প্রায়ই দেখা যায় ম্যাচ চলাকালে একে অপরকে পেটানোর পর দু’জন রেসলারই রিংয়ে কুপোকাত। তখন রেফারি কাউন্ট করতে থাকে। ছবির এক পর্যায়ে এসে মনে হয়েছে কিছু ঘটনা স্রেফ সময় কাউন্ট করে যাচ্ছে, মূল গল্প আর ডিরেক্টর দু’জনই রেসলিং করে কুপোকাত। সেই সময়টুকু চিয়ার করার মতো কিছু না পেয়ে দর্শকরা বিনোদনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে নানা মন্তব্য শুরু করল। রুহির একটি সংলাপ ছিল- ‘ও আমাকে ভালোবেসে পেটায়’। একজন বলে উঠল- ‘বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তো একটু মাইরাই খেলে।’ ছবির বাকি বর্ণনার প্রয়োজন নেই। ট্রেইলার দেখে যারা হলে যাবেন তাদের ধরা খাওয়ার আশংকাই বেশি। অতএব যারা হলে যাবেন তারা যেন জিরো এক্সপেকটেশন নিয়ে যান। তাহলে হয়তো ভালো লাগার সম্ভাবনা তৈরি হলেও হতে পারে। আর সেটা যৌনতানির্ভর।

রেসলিংনির্ভর এ ছবিতে মাহফুজের চরিত্রটি অনেকটা আন্ডারটেকারের মতো। তিনি বদ্ধ অন্ধকার ঘরে থাকেন। সেই ঘরে এতই গন্ধ যে জয়ার মতো খুনিও সেখানে ঢুকে নাক-মুখ কুচকে ফেলে। আর রুহি তো বলেই ফেললেন- ‘বাবাগো, কী গন্ধ’। অথচ দর্শকরা রহস্যের গন্ধের জন্য হলে এসে কিছুই পেলেন না। জয়া আর রুহি আন্টি (দু’জনকেই ছবিতে আন্টিদের মতো বয়স্ক লেগেছে) অন্ততপক্ষে কিছু একটার গন্ধ পেলেন। পরিচালক এ ছবিতে ব্ল্যাক থ্রিলার, ডার্ক থ্রিলার বা কালা থ্রিলার যেভাবেই বর্ণনা করুক না কেন, ছবিতে রহস্যের কোনো গন্ধ নেই। নেই কোনো চমক। প্রতিশোধপ্রবণ চরিত্রের এ ছবিতে হয় প্রতিশোধকারী হাঁটতে হাঁটতেই রাস্তার মোড়ে তার টার্গেটকে পেয়ে যায় নতুবা টার্গেট কোনো অতীব কাকতালীয়ভাবে তার সামনেই হাজির হয়। মনে হয়েছে পরিচালক একটি ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছেন। ছবিতে বলিউডকে ফলো করা হয়েছে, তামিল ছবি দ্বারা প্রভাবিত এবং যৌন দৃশ্য সংযোজন করে হলিউডকে অনুসরণ করার বিষয়টি প্রকট। এসব বাদ দিলে জিরো ডিগ্রীকে একটি নাটক বলা যায়। কিন্তু কিছু বিষয়ে খটকা লাগে। মাহফুজকে কোনো কারণেই নায়ক বলে মনে হয়নি। সবসময় যৌন দৃশ্যের প্রতিই তার আকর্ষণ প্রবল ছিল বলেই মনে হয়েছে। ল্যাপটপে প্রেমিকের সঙ্গে চ্যাট করতে গিয়ে রুহির বুকের ক্লিভেজ দেখানোটা অশ্লীল বৈ আর কিছু নয়। গানের শুরুতে জয়ার বুকে হাত দেয়ার দৃশ্যটা সেন্সর বোর্ড ছাড়ল কীভাবে? বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। প্রেমিকের সঙ্গে জয়ার বিছানার দৃশ্য যৌন সুড়সুড়ি দেয়া ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যার দাবি রাখে না। বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসার আড়ালে দেহব্যবসা করা হয় কিংবা হাসপাতালে রোগীর বদলে খদ্দের অবস্থান করে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। পুরো ছবিতে যৌনতার সুড়সুড়ি ছিল ভয়াবহ রকমের। এরকম হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয়া এ ছবি নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ছবিতে আবিদা সুলতানার গাওয়া ‘বিমূর্ত এই রাত্রি’ গানটি চুরি করে ব্যবহার করা হয়েছে। আবিদা এর প্রতিবাদ করায় পরিচালক অনিমেষ আইচ এই গুণী শিল্পীকে ‘ফালতু শিল্পী’ বলেও অপমান করেছেন। এক টিভি সাক্ষাৎকারে মাহফুজ ছবির শুটিংয়ে এক বোতল ‘টাকিলা’ (বিদেশী মদ) হজম করার কথা বলে দম্ভোক্তি করেছেন। তাতে মনে হয়েছে, তিনি যে মাদকের প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষণ অনুভব করেন তা দর্শকদের জানাতে চান! তবে কী এ প্রচারণায় তরুণ সমাজকে মাদকের প্রতি আসক্ত হতে উৎসাহিত করেছেন মাহফুজ! যেখানে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে সেখানে, মাহফুজের এমন মন্তব্য সমাজ ও ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকে। সবকিছু মিলে জিরো ডিগ্রীর প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, ছবি দেখার পর সে প্রত্যাশা ‘জিরো’-তে নেমে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এ ধরণের যৌন সুড়সুড়ি দেয়া অশ্লীল ছবি জিরো ডিগ্রী পরিবার-পরিজনদের নিয়ে দেখা সম্ভব নয়। মূলত, এ ছবির মাধ্যমে ঢাকাই চলচ্চিত্রে ‘অশ্লীলতা’ নামের শব্দটি আবারো জেঁকে বসবে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More