লন্ডন, ১৩ জুলাইঃ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আইনের শাসন একদিকে চরম হুমকির মুখে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অব্যাহত বিস্তার দেশটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার না থাকায় মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার ভুলন্ঠিত। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা কার্যত সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। জনগণের কোনোভাবেই তার প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। পরিস্থিতির উন্নয়নে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা জরুরী।
মঙ্গলবার হাউস অব কমন্সের কমিটি রুমে আয়োজিত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বৃটিশ পার্লামেন্টের শীষস্থানীয় এমপিরা।
সিটিজেন মুভমেন্ট ইউ কে আয়োজিত সর্বোচ্চ সংখ্যক এমপি ও লর্ডের উপস্থিতে সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন বৃটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশ সংক্রান্ত সর্বদলীয় কমিটির সহ-সভাপতি সায়মন ড্যানসক এমপি। সেমিনারে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ বিষয়ক অল সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি, লর্লি বার্ট এমপি, নিস ডাকিন এমপি, রিচার্ড ফোলার এমপি, পাওয়েল ব্লুমফিল্ড এমপি, জেমস কার্টেইজ এমপি, এ্যান্ড্রু স্টিভেন এমপি, এ্যান্ডু সিমেন্স এমপি, জিম পেট্রি এমপি, মার্ক ডারকান এমপি, লর্ড হোসাইন, লর্ড কোরবান আলী, বাংলাদেশের সাংবাদিক ও ইউএনসিএ সদস্য মুশফিকুল ফজল আনসারী, ড. হাসনাত হোসেন এমবিই, ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা, মুফতি সদরুদ্দিন ও মানবাধিকার কর্মী মাহবুব আলী খান। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সিটিজেন মুভমেন্ট ইউকে’র আহবায়ক এম এ মালেক।
সেমিনারে বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপিগণ বলেন, বাংলাদেশে অগ্রহণযোগ্য সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে। দেশে দীর্ঘদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচনহীন শূন্যতার কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশে এখনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধসে পড়েছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা।
বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে হাউস অব কমন্সে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। তিনি অভিযোগ করেছেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতা ধসে পড়েছে।
তিনি বলেন, হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবে কনজারভেটিভ, লেবার, লিবারেল ডেমোক্র্যাট সবাই একমত পোষণ করেছে। এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় এবং শিগগিরই সবার অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সব দলের সদস্য একমত হয়েছেন।
ব্রিটিশ এমপি সায়মন ডানসাক বলেন, বাংলাদেশে যে কোনো সময় গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। বাংলাদেশে সুশীল সমাজ চুপসে যাচ্ছে এবং সুশীল সমাজের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে জঙ্গিরা। অতীতে মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে ক্রমেই জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ছুরি ও চাপাতির আঘাতে যাদের খুন করা হয়েছে তাদের হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী। যদিও বাংলাদেশ সরকার এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা নাকচ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আইনের শাসন একদিকে চরম হুমকির মুখে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অব্যাহত বিস্তার দেশটির ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে তুলেছে। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার না থাকায় মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার ভুলন্ঠিত। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা কার্যত সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। জনগণের কোনো ভাবেই তার প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। পরিস্থিতির উন্নয়নে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা জরুরী বলে মত দেন বৃটেনের শীর্ষ এই রাজনীতিক।
রিচার্ড ফোলার এমপি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনীতিবিদদের মধ্যে অবশ্যই সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরস্পরের প্রতি আস্থা নেই। তিনি বলেন, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হলে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ক্রসফায়ার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ফোলার বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। সন্ত্রাসী হামলার সঠিক তদন্ত না হওয়ায় দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান দেখা দিচ্ছে ।
পাওয়েল ব্লুমফিল্ড এমপি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি মর্মে এরই মধ্যে বৃটিশ পার্লামেন্টে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসতে হবে।
জেমস কার্টেইজ এমপি বলেন, বাংলাদেশে অবিলম্বে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে একদলীয় সরকার গঠন করা হয়েছে। এটাকে গণতন্ত্র বলা যায় না।
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, বর্তমান অনির্বাচিত সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক। বিরোধীদলে থাকাকালীন শেখ হাসিনা বাংলাদেশ তালেবান ও জঙ্গিবাদের আখড়া বলে বহিবিশ্ব প্রচারণা চালিয়েছেন। অথচ তার সরকারের সময় জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটলে সন্ত্রাসী নানা কর্মকান্ডের জন্য বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে এসব ‘পশ্চিমাদের আবিষ্কার’ বলেও মন্তব্য করেছেন। অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে উপলক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করছেন, যা বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার। বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পথে ফেরাতে দেশটির উন্নয়নের বৃহত্তম অংশীদার গ্রেট বৃটেনকে আরো জোরাল ও কার্যকর ভূমিকা রাখার আহবান জানান জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশী এই সাংবাদিক।
ড হাসনাত হোসেন এমবিই বলেন, দেশে প্রতিদিন মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। চলছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড। তিনি বলেন, জনগণের বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সরকার হরণ করেছে। সন্ত্রাসবাদকে সরকার প্রশয় দিচ্ছে উল্লেখ করে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে বৃটেনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানান বৃটিশ এই শিক্ষাবিদ ।
ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা বলেন, ৫ জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এটা বর্তমান সরকারেরই একটি পূর্ব পরিকল্পনা। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এই হামলা হচ্ছে। এর সঙ্গে সরকারি দলের লোকরাই জড়িত। বিভিন্ন জায়গায় হামলা করার সময় সরকারি দলের লোকরা ধরা পড়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের প্রক্রিয়া চলছে বলে বক্তব্য দেন তিনি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, সরকার ভিন্নমতকে পুরোপুরি দমন করেছে। এরই মধ্যে দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন এবং এক সময় বর্তমান সরকারি দলের সমর্থক ছিল, হালে ভিন্নমত পোষণকারী পত্রিকাও রেহাই পায়নি। এরই ধারাবাহিকতায় বন্ধ করা হচ্ছে মিডিয়া। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডের নামে পুলিশ হেফাজতে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। এখনও কারাগারে তাকে নানা নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। সাংবাদিক শফিক রেহমান দীর্ঘদিন ধরে জেলে বন্দি ।
তিনি বলেন, সরকার নানা নিবর্তনমূলক নানা আইন প্রনোয়ন করে বিরুদ্ধ মত দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ঠেকসই উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন জরুরি বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের এই রাজনীতি বিশ্লেষক।
সিটিজেন মুভমেন্টের চেয়ারম্যান এম এ মালিক বলেন, বাংলাদেশে এখন ভারতের উপনিবেশ। আন্তর্জাতিক মহল এখনই শেখ হাসিনার গণবিরোধী সরকারকে হটাতে ব্যর্থ হলে জনগণ নিজেরা যদি মোকাবেলা করে তবে সেটি হবে আরো একটি বিপর্যয়।
সেমিনারে অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইউকে বিএনপির কয়সর এম আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, আনোয়ার হোসেন খোকন, কামাল উদ্দিন, তাজউদ্দিন, খসরুজ্জামান খসরু, মোশাহিদ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ খান, গোলাম রব্বানী, নুর বকস, নাসির আহমদ শাহীন, রহিম উদ্দিন, আফজাল হোসেন, জুল আফরোজ, জিয়া, শিমু, জাহেদ আহমেদ তালুকদার প্রমুখ।
এ ছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল ল’ইয়ার্স ভয়েসের সভাপতি ব্যারিস্টার এমএ সালাম, সাবেক ছাত্রনেতা পারভেজ মল্লিক, কলামিস্ট ড. মুজিবুর রহমান, সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান ও মুহাম্মদ নূরে আলম, মানবাধিকার সংগঠক মনিরুল হক, এস এম মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান, ব্যারিস্টার হামিদুল হক লিটন আফিন্দি, সলিসিটর নাসের খান অপু, জাহিদ হাসান গাজী প্রমুখ সেমিনারে যোগদেন।