সিরিয় শরণার্থীরা যাতে হাঙ্গেরীতে ঢুকে পড়তে না পারে সেজন্যে দেশটির সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়োজিত করেছে সীমান্তে। তারচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে অনেক শরণার্থীকে স্বাস্থ্য পরীÿার নামে উলঙ্গ করা হচ্ছে। সিরিয়ার যে সব শরণার্থী নতুন জীবনের সন্ধানে ইউরোপে আসছেন তাঁদেরই কয়েকজনকে ক্যামেরায় ধরে রাখছেন রয়টার্সের আলজিরীয় চিত্রসাংবাদিক জোহরা বেনসেমরা৷ যেখানে বলা হচ্ছে শরণার্থী সমস্যায় সব থেকে ইতিবাচক ভূমিকা জার্মানির, সেখানে বেনসেমরা বলছেন বা¯Íবচিত্র কিছুটা আলাদা৷ তাঁর বয়ানেই শোনা যাক এক সিরীয় পরিবারের দুর্দশার কথা৷
দক্ষিণ জার্মানির রোজেনহাইম স্টেশনে নামার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইহাবের পরিবারের একটা গোটা দিন কেটে গেল পুলিশ স্টেশনে৷ সেখানে ধূমপান নিষেধ, তাই ইহাবের উদ্বেগ কিছুতেই কমে না৷ ছোট মেয়ের কান্না থামছে না, কিন্তু তার মা আবিরের ওষুধ আনার কোনও উপায় নেই৷ শৌচাগারে একা যাওয়ারও অনুমতি নেই৷ আবির বললেন, ‘ভাবতে পারবেন না ওই অভিজ্ঞতা কত অপমানজনক ছিল!’
ইহাব ও আবির ইউফ্রেটিস নদীর পাড়ের সুন্নিপ্রধান শহর দেইর-আল-জোর-এর বাসিন্দা৷ দেশের গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে তাঁরা প্রথমে আসেন তুরস্কে৷ সেখান থেকে নৌকা, বাস, ট্রেন ও কিছুটা পায়ে হেঁটে জার্মানি৷ তাঁদের আশা ছিল, গন্তব্যস্থল উত্তর জার্মানি পৌঁছতে বেগ পেতে হবে না৷ পুলিশও যে হয়রানি করতে পারে, সে কথা তাঁদের একবারও মনে হয়নি৷
থানায় আসার সাত ঘন্টা পরে ভোর ছ’টায় শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ৷ ‘সিরিয়ার ঠিক কোন জায়গা থেকে আসছেন? আপনাদের ক’টি সন্তান? সঙ্গে কী কী কাগজপত্র আছে?’ পুরো কথোপকথনই চলে দোভাষীর মাধ্যমে৷ ইহাবের কাছে সেই দোভাষীর আচরণ ছিল পুলিশের থেকেও বেশি ভয়ের৷
এর প্রায় ১২ ঘন্টা বাদে, সন্ধ্যা সাতটায় আবার ডাক এল থানা থেকে৷ এবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য৷ ইহাব বললেন, ‘পুরো উলঙ্গ করে আমার দেহ তলøাশি করল ওরা৷ মনে হচ্ছিল বাশার আল আসাদ (সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট) বাহিনীর কাছেই যেন আমি বন্দি৷ দুয়ে কোনও তফাৎ নেই৷ থানা ছাড়ার আগে ওরা আমাদের ছবি তুলল৷ আমি বুঝি দেশকে রক্ষা করা তাদের ধর্ম৷ চিরকালই, কিছু লোকের খারাপ কাজের দাম মেটাতে হয় ভাল লোকেদেরই৷’
মধ্যরাতের কিছু পরে ইহাবের পরিবারকে রেল স্টেশনে ফেরত পাঠানো হয়৷ ভোর সাড়ে চারটেয় মিউনিখের ট্রেন আসে৷ কয়েক ঘন্টা পরে শ্রান্ত, ক্লান্ত পরিবারকে নিয়ে স্টেশনে নেমে নতুন সিম কিনে ইহাব আমায় ফোন করে৷ চব্বিশ ঘন্টা ওদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না৷ আবার দেখা হওয়ার পর, সবাই মিলে লুবেক-এর টিকিট কিনলাম৷ হ্যামবার্গ হয়ে যেতে হবে৷ যখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি তখন শূন্য দৃষ্টি মেলে আবির বললেন, ‘নিজের দেশে হিজাব পরি আর এখানে এসে জীবনে প্রথম অপরিচিতদের সামনে পোশাক খুলতে হল৷ ওই ২৪ ঘন্টা কখনও ভুলতে পারব না৷’
এদিকে শরণার্থীদের গ্রহণের ব্যাপারে গত কয়েকদিন ধরেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে ইউরোপ, বিতর্ক চলছে দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের মধ্যে।
এরই মধ্যে হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সেøাভেনিয়ার মতো দেশগুলোতে শরণার্থীদের আটকে দেয়ার এবং পাশের দেশে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা চোখে পড়েছে।
এর কারণ কি? বিবিসি বাংলার কাছে যুক্তরাজ্যের সোয়্যাস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক খান এর পেছনে দুটি কারণকে উলেøখ করছেন।
তিনি বলছেন, শরণার্থীরা মূলত যেসব দেশ দিয়ে পার হয়ে পশ্চিম ইউরোপে আসতে চাইছে সেগুলো ইউরোপের নতুন দেশ, যেমন হাঙ্গেরি এবং ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশ। তাদের এশিয়া আফ্রিকার দেশের সাথে সেরকম কোন সম্পর্ক ছিল না, তাদের কোনও ঔপনিবেশিক ইতিহাস নেই, ওই সব দেশে এশিয়া আফ্রিকার লোকেরা থাকে না।
তিনি বলেন, এই পরিমাণ লোক যখন এইসব দেশ দিয়ে পার হবার চেষ্টা করছে, এইসব দেশে তখন এক ধরণের খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। এবং এই শরণার্থীরা বেশীরভাগ মুসলমান, এশিয়ান, তাদের বিরুদ্ধে এক ধরণের বর্ণবাদী প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর ঔপনিবেশিক ইতিহাস রয়েছে উলেøখ করে ড. খান বলছেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য বা জার্মানির মতো দেশ এশিয়ায়, আফ্রিকায় শাসন করেছে, ফলে দেশগুলোতে এই শরণার্থী নিয়ে খুব একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি।
বরং প্রথম দিকে এই দেশগুলোতে এক ধরণের সহানুভূতিশীল আচরণ আমরা দেখেছি। তিনি বলেন, এখন লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে চাইছে। ফলে ফ্রান্স ও জার্মানির মত দেশকেও এখন আতঙ্কিত হতে দেখা যাচ্ছে, কারণ চলিøশ-পঞ্চাশ লাখ লোক যদি এখন ইউরোপে আসে তাহলে পশ্চিম ইউরোপের বড় দেশগুলোও এত লোককে বহন করতে পারবে না।