ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাই ও বিক্রি নিষিদ্ধ করায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। এ ঘটনায় মহারাষ্ট্রের মতো সম্পদশালী রাজ্যেও অগণিত কৃষক দারিদ্র্যের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছেন। এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে মোদির সরকারের বিরুদ্ধে।
রয়টার্সের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গোবধ হিন্দুস্তানে ধর্মীয়ভাবে গর্হিত কাজ বলে বিবেচিত হওয়ায় অধিকাংশ রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম বড় গরুর মাংস রপ্তানিকারক।
বিজেপির সরকার মহারাষ্ট্রসহ কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখতে গরু ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি করে এবং হামলা চালায় কতিপয় হিন্দু।
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যার বিশ্বাসের ওপর আঘাতের অভিযোগে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এসব গোবধ নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর আইন জারি করে। ভারতের প্রায় ১৮ কোটি মুসলিমসহ অনেকে এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গরুর মাংসের ওপর এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে। এতে করে সারা দেশে কমে গেছে গরুর দাম। কমেছে মাংস রপ্তানিও। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নয় মাসের মধ্যে দেশটির ১৩ শতাংশ মাংস রপ্তানি কমে গেছে। গরুর মাংস রপ্তানিকারী প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল এগিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ভারত। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশটির কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর। লাখো কৃষক জের টানা খরা ও অসময়ের বৃষ্টির কারণে ভালো ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। এ কারণে গবাদি পশুকে পর্যাপ্ত দানাপানি দিতে পারেননি। নিষেধাজ্ঞার কারণে গরু বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়েছে কৃষকদের। এতে তাঁরা শঙ্কিত।
রিভাজী চৌধুরী নামের একজন কৃষক মহারাষ্ট্রের একটি বাজারে গত এক সপ্তাহ ধরে এক জোড়া ষাঁড় বিক্রির চেষ্টা করছেন। ওই ষাঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমি অবাক হয়ে ভাবি—সরকার কী চায়? আমাদের বেঁচে থাকা, না গরুর?’
কৃষকেরা সাধারণত খরার মৌসুমে গরুগুলো বিক্রি করে থাকেন। বর্ষার পরে যখন আয় বাড়ে, তখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নতুন করে গরু কেনেন।
কৃষকেরা গরু বিক্রির ওই অর্থে পরবর্তী কৃষি মৌসুমের (সাধারণত জুনে শুরু) জন্য বীজ ও সার কেনেন। মহারাষ্ট্রের খরাকবলিত মারাঠা ওয়াদা এলাকায় কৃষক আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ হয়েছে।
গরু নিষিদ্ধ না নিষিদ্ধ নয়?
বিজেপির এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতে ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ বেশি চিন্তিত।
গত বছর বিজেপি কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনে পরাজয়ের নেপথ্যের কারণ বলা হয় এটিকে। এ বছরে আরও কয়েকটি প্রদেশে নির্বাচন হবে। এতেও সেই হার (নির্বাচনে হেরে যাওয়া) বেশি হওয়ার কথা।
গত মাসে এ বছরের বাজেটে মোদির সরকার পল্লি উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় এখনকার চেয়ে দ্বিগুণ করাই এর উদ্দেশ্য।
মহারাষ্ট্রে বিজেপির বিধায়ক ভিমরাওধোন্দে রয়টার্সকে বলেন, কৃষকদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং যেখানে ইচ্ছা, সেখানে তাঁদের (কৃষক) গরু বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া উচিত। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এখন সময় এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার।’
মহারাষ্ট্র রাজ্যে বিজেপির মুখপাত্র মধু চৌহান বলেন, ভিমরাওধোন্দের দৃষ্টিভঙ্গি দলের নয়। তিনি বলেন, ‘পার্টি মনে করে এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, খরার প্রভাব থেকে কৃষকদের মুক্ত করার জন্য যত বেশি অর্থের প্রয়োজন তা খরচ করা হবে।
লাখ লাখ গরু
মহারাষ্ট্রের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই। এই প্রদেশটি খরা আক্রান্ত একটি প্রদেশ। এই প্রদেশের একটি জেলায় সরকার আদেশ জারি করেছে যে, একটি পানির ট্যাংকের কাছে পাঁচজনের বেশি মানুষ যেতে পারবে না। দাঙ্গা প্রতিরোধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গরু ও মহিষের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৭০ লিটার পানির প্রয়োজন। এ জন্য অনেক কৃষক কেবল তাঁদের গবাদিপশু পালন করা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
এই রাজ্যে পশুর অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জায়গা স্বল্পতার কারণে আড়াই লাখ গবাদিপশু তাদের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহারাষ্ট্রের অন্তত প্রায় চার কোটি পশুর দেখাশোনা করা প্রয়োজন।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন তারা বলছে, সরকারের সহায়তা কম ছিল এবং সরকারকে আরও অনেক কিছু করতে হবে।
ভিএইচপির গবাদি পশু সুরক্ষা কমিটির মহারাষ্ট্র ইউনিটের প্রধান লক্ষ্মী নারায়ণ চন্দক বলেন, তাঁর সংগঠন শুধু ১৫০টি গবাদিপশুর আশ্রয় দিতে পারে।
তিনি বলেন, ‘প্রায় সাত লাখ গরু ও ষাঁড় না খেয়ে মারা যেতে পারে। অথবা এসব পশু জবাই বা পাচার হয়ে যাবে। আমাদের পশুগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’
প্রতি সোমবার মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ের পূর্বদিকের ২০০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বেলহায় চৌধুরী বাজারে সাপ্তাহিক একটি পশুর হাট বসে। প্রত্যাশার চেয়ে কম মানুষ এখানে গরু কেনাবেচা করছে। এ রাজ্যে গরুর দাম ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
এই বাজারের ইজারাদার চৌধুরী বলেন, বছরে গরু বিক্রির অর্থ থেকে প্রায় দুই লাখ রুপি আয় হয়। খরার কারণে পশু বিক্রি কমে গেছে। এতে লোকসান হচ্ছে।
তিনি বলেন, আগে একটি ষাঁড়ের মূল্য ছিল ৪০ হাজার রুপি। এখন এর দাম অর্ধেক ২০ হাজার রুপি হয়েছে। এখন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘আমাদের পানির ট্যাংকারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কীভাবে আমরা পশুর পানি সরবরাহ করব?’