যাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন ভারতের মুসলিমরা

0

119130_1ঢাকা: একটা মাঠে জড়ো হয়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। সবাই মুসলিম। প্রচণ্ড গরমের মাঝে খোলা মাঠে এত মানুষের আনাগোনায় আশাপাশের এলাকা ধূলিধূসরিত। গরম আর ধূলোবালুর মধ্যেও মানুষগুলোর মধ্যে কোনো বিরক্তি নেই। নেই কোনো তাড়াহুড়া। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাদের পরম কাঙ্খিত মানুষটির দেখা পাওয়ার জন্য।

নিজেদের নেতাকে কাছে থেকে দেখতে চান একটিবার। শুনতে চান তার অগ্নিঝরা বক্তব্য। সামনের দিনগুলিতে নিজেদের করণীয় ঠিক করবেন নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী। ‘অল্প বয়স্ক’ হলেও এই মানুষটির ওপর আগন্তুকদের ভরসা আকাশ সমান।

অল্পক্ষণ পরেই মাঠে এসে পৌঁছালো একটি মাইক্রোবাস। সেটি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ঝলমলে তরুণ। গায়ে পাঞ্জাবি-পাজাম, মাথায় টুপি। দাড়িভর্তি মুখটিতে মিষ্টি হাসি। গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মুরুব্বি গোছের লোকজনের সাথে একে একে কোলাকুলি করছেন তিনি। সাথে সাথে উপস্থিত তরুণদের কণ্ঠে গর্জে উঠলো স্লোগান। ‘দেখো দেখো কে এসেছে! আমাদের সিংহ এসেছে!’

এই ‘সিংহের’ নাম আসাউদ্দিন ওয়াইসি। দক্ষিণ ভারতের এই তরুণ এখন ভারতজুড়ে মুসলমানদের আশার প্রতীক। উচ্চশিক্ষিত, একই সাথে ধার্মিক এবং আধুনিক চিন্তা চেতনাধারী এই সম্ভাবনাময় তরুণকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন ১৮ কোটি মুসলমান।

অনলবর্ষী এই বক্তার সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা দেখে ভারতের মুসলিমবিদ্বেষী উগ্রবাদীদের কপালে ইতোমধ্যে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ওয়াইসিকে নিয়ে ইতোমধ্যে নানা কু-কথা বলতে শুরু করেছে উগ্র-হিন্দুত্ববাদীরা।

ওয়াইসি মঞ্চে উঠার সাথে সাথে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করা হল। তারপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্য দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন তিনি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে ভারতের মুসলিম তরুণরা চাকরি, শিক্ষা, ব্যাংক ঋণ এবং পুলিশের সহায়তা থেকে বঞ্চিত। কিভাবে জোর করে পিছু টেনে ধরা হয়েছে এক সময় ভারতবর্ষ শাসন করা এবং এটিকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করা মুসলমানদেরকে।

মুসলিম তরুণদের নিয়মিত নামাজ আদায় এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ওয়াইসি তার বক্তব্য বলেন, ‘এই দেশ যতটা আপনাদের (হিন্দুদের), ঠিক ততটা আমাদেরও। আমরা এখানে ভাড়া থাকি না। এ জমির মালিক আমরাও। আমাদেরকে আমাদের অধিকার দিতেই হবে।’

বক্তব্য শেষে তার সাথে হাত মেলানোর জন্য অনেক তরুণ দৌড়ে স্টেজে উঠে পড়েন। তাকে ঘিরে রেখে যাত্রা আধা ঘণ্টা দেরি করিয়ে হাত মেলান কয়েকশ ভক্ত তরুণ।

২২ বছর বয়সী স্থানীয় একজন দোকানদার সাইয়েদ জাওয়াদ বলেন, ‘আমি এর আগে এমন ভয়-ডরহীন কোনো নেতা দেখিনি। ওয়াইসি আমাদের নতুন পথের দিশারী।’

ওয়াইসি দক্ষিণ ভারতের একটি ছোট দলের (অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) হয়ে ইতোমধ্যে তিনবার পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং বর্তমান মোদির ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানের সময় তিনি মুসলিমদের মধ্যে একজন উদীয়মান তারকা নেতায় পরিণত হয়েছেন। যেখানে ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ শতাংশ মুসলিম হলেও তাদের তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রভাব নেই।

৪৬ বছর বয়সী ওয়াইসিকে ‘মুসলিম কমিউনিটির সুপারস্টার’, ‘সত্যবাদী রাগী তরুণ নেতা’ এবং ‘আশার আলো’ ইত্যাদি অভিধায় ইতোমধ্যে ভূষিত করা হয়েছে।

ভারতের পার্লামেন্টের নিম্মকক্ষে ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে মাত্র ২২ জন মুসলিম এবং উচ্চকক্ষের ২৪৫ জনের মধ্যে ২৪ জন মুসলিম।

দিল্লিতে দেয়া সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ওয়াইসি বলেন, ‘আমি চাই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরির জন্য মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হোক। মুসলমানরা ব্যতীত ভারতের সব সম্প্রদায় উন্নতি করেছে। আমাকে উস্কানিদাতা বলতে পারেন, বলতে পারেন দেশবিরোধী। কিন্তু এসবের আগে আমি বৈষম্য এবং অবিচার নিয়ে যেসব প্রশ্ন করছি সেগুলো উত্তর আপনাকে দিতে হবে।’

সম্প্রতি ওয়াইসি আলোচনায় আসেন ১৯৯৩ সালের মুম্বাই বোমা হামলায় অভিযুক্ত ইয়াকুব মেমনকে ফাঁসি দেয়া বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে। তিনি বহু অমুসলিম খুনি এবং মুসলমানদের হত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে দেখিয়ে দেন যে মেমনের মুসলিম পরিচয়ের জন্যই শুধু তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ভারতে সর্বোচ্চ শাস্তি দণ্ডটি এখন রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অবশ্য ওয়াইসির সমালোচকরা বলছেন, তার ক্ষুরধার বক্তব্য দেশটিতে বহুধর্মীয় সামাজিক অবস্থানের ভঙ্গুর অবস্থাকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে।

বিজেপির জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধব বলছেন, ওয়াইসি মুসলমানদের মধ্যে অনিরাপত্তার অনুভূতি জাগিয়ে দিচ্ছেন। তার এই রাজনীতি ভারতের জন্য ভয়ংকর, কারণ এটি মুসলমানদের ভেতরে বঞ্চিত হতে থাকার অনুভূতিকে আরো গেঁথে দেবে।

মাধব সমালোচনার দৃষ্টিতে আরো বলেন, ওয়াইসি চাচ্ছেন ২১ শতকের জিন্নাহ হতে।

আসাউদ্দিন ওয়াইসির বেড়ে ওঠা মুসলমি সংখ্যাগরিষ্ঠ হায়দারাবাদে। ব্রিটেনে আইনের ওপর পড়াশোনা করেছেন। তার বাবাও এমপি ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া ওয়াইসি নিজে একটি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল পরিচালনা করেন।

জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আরশাদ আলম বলেন, ওয়াইসি উচ্চশিক্ষিত। যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। তিনি জানেন কিভাবে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো করতে হয়। ইংলিশে কথা বলতে এবং এলিটদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে তিনি সক্ষম। আত্মবিশ্বাহীনতায় ভোগা একটি কমিউনিটির জন্য তার এসব যোগ্যতা কিছু ঘাটতি পূরণ করে দিচ্ছে। কিন্তু দেখার বিষয় যে, তিনি কি শুধুই সংঘাতের রাজনীতি করতে যাচ্ছেন নাকি তার উর্ধ্বে উঠে কিছু করতে পারবেন?

ওয়াইসি সব সময় পকেটে জায়নামাজ নিয়ে চলাফেরা করেন। অরুনাবাদে এক সমাবেশে তার বক্তৃতার সময় আযান শুনতে পেয়ে সাথে সাথে তিনি স্টেজ ত্যাগ করে নামাজের জন্য চলে যান। তাকে অনুসরণ করে মসজিদের নামাজ আদায়ে যান কয়েক হাজার মুসল্লি। অন্য রাজনীতিবিদদের মতো ওয়াইসি তার সাথে কখনো পুলিশ গার্ড রাখেন না। প্রতিদিন নিজের নির্বাচনি এলাকার মানুষদের সাথে সাক্ষাৎ করেন তার কার্যালয়ে।

মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরিতে যাতে কোটা নিশ্চিত হয় এ জন্য তিনি আইনসভায় চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি যেখানে যাই মানুষদেরকে দুইটা কথা বলি। এক. নিজেকে শিক্ষিত করো। দুই. রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হও। এই কমুনিটির জন্য হজ করতে ভর্তুকি আর রমজান মাসে সরকারি টাকায় বিশাল ভোজন আয়োজনের দরকার নাই। আমরা শিক্ষা আর চাকরি চাই। এই দুটির মাধ্যমে এক দশকের মধ্যেই একটি বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব।

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More