আমাদের গন্তব্য ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের শহর মোরে। পাহাড় শুরু হতেই দেখা গেল- আসাম রাইফেলসের তৎপরতা। পাহাড়ে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব তাদের। পাহাড়ি এলাকায় ঢোকার পরেই চোখে পড়লো পরপর কয়েকটা সাঁযোয়া যান। তার পাশে আসাম রাইফেলসের সদস্যরা। গাড়ি থামিয়ে প্রথম নির্দেশ, ‘ক্যামেরা বন্ধ করুন। আমাদের ছবি তুলবেন না।’ পরিচয়পত্র দেখে তারপর ছাড় পাওয়া গেল।
পাহাড়ে উঠতেই দৃশ্যপট আরো সুন্দর হয়েছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। দু’পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল। গরম থেকে ধীরে ধীরে একটু ঠান্ডা লাগছে। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে খরস্রোতা নদী বইছে। কোথাও বৃষ্টির পানি নেমে আসছে রাস্তায়। তারমধ্যেই একজায়গায় অনেকখানি রাস্তাজুড়ে বাঙ্কার। সবই আছে শুধু মানুষ নেই। মানুষের দেখা পাওয়া গেল একটু পরে।
এভাবে গোটা দুই তিন চেটপোস্ট পার হওয়ার পর এবার গাড়ি থামলো তেঙ্গউপলে একটু বড় চেক পোস্টে। এখানে নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব লেখাতে হবে। সেখান থেকে বার্তা গেল ওপরমহলে। ডিডাব্লিউর সাংবাদিকরা মোরে যেতে চান। আধঘণ্টা পরে অনুমতি পাওয়া গেল। একটু এগোতেই এবার কুকি মেয়েদের চেকপোস্ট। অন্তত শ-দেড়েক নারী বসে আছেন মাঝরাস্তায় চেয়ার পেতে। বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় দিয়েও তারা ভিজছেন। কিন্তু রাস্তা থেকে নড়ছেন না। তাদের কাছাকাছি আরো অন্তত এক শ’জন নারী বসে আছেন। তাদের ফাঁকি দিয়ে কেউ এখান থেকে যেতে পারবেন না।
মনে পড়ে গেল, চূড়াচাঁদপুর যাওয়ার রাস্তায় ঠিক এইভাবেই মেইতেই মেয়েদের রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখেছি। প্রতিটি গাড়ির দিকে তারা কড়া নজর রাখছেন।
কেন এই নজরদারি? মেইতেই ও কুকিরা ঠিক একই যুক্তি দেন। অন্যপক্ষ যাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে না পারে, অন্যপক্ষের কেউ যাতে তাদের এলাকায় ঢুকতে না পারে, সেজন্যই এই নজরদারি। ঠিক সময়ে এই নারীদের কাছে চলে আসে সকালের খাবার, মধ্যাহ্নভোজ, চা-নাস্তা এবং নৈশভোজও। ডিউটি ভাগ করা আছে। পুরো ২৪ ঘণ্টাই তারা নজর রাখেন পরিস্থিতির উপর। এটাই এখন তাদের সবচেয়ে বড় কাজ।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, কোনো কুকি ড্রাইভার উপত্যকায় যেতে পারেন না, কোনো মেইতেই চালক পাহাড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। একমাত্র মুসলিম চালকরাই দুই জায়গায় যেতে পারেন। ইম্ফলে থাকা মুসলিম চালকরা গাড়ি নিয়ে গেলে কুকিরাও কিছু বলেন না। আবার পাহাড় থেকে মুসলিম চালকের গাড়ি দেখলে মেইতেইরা উত্তেজিত হন না। দুই পক্ষের কাছেই মুসলিমরা নিরাপদ। তারা কোনো পক্ষই নেননি। যেমন নেননি নাগাসহ অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষরা। আমরা ফেরার পথে দেখেছিলাম, একটা গ্রামের বাইরে বড় করে ব্যানার লাগানো। তাতে লেখা ‘এটা নাগাদের গ্রাম’। নাগারাও কোনো পক্ষ নেননি। কেউ যাতে ভুল করে আক্রমণ না করে বসে, তার জন্য এই আগাম সতর্কতা।
মণিপুরে যেখানেই যান না কেন, মেইতেই ও কুকি এই দুই তরফের অবিশ্বাস ও সন্দেহের ঘেরাটোপ আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে। দু’পক্ষের অভিযোগ একই। তেঙ্গউপলে কুকি স্টুডেন্টস অ্যায়োসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট থাংবোই বলছিলেন, ‘আক্রমণ তো আগে শুরু করেন মেইতেইরা। আপনারা ইম্ফলে কুকিদের জ্বালিয়ে দেয়া ঘর দেখেছেন? সংঘর্ষে তো সবচেয়ে বেশি কুকি মারা গেছেন। আমরা আর কিছু চাই না। আমরা চাই আলাদা প্রশাসন। পাহাড়ের জন্য, কুকি জো-দের জন্য।’
আলাদা প্রশাসন মানে কী? আলাদা রাজ্য? থাংবোইয়ের জবাব, ‘সেটা তো সরকার ঠিক করবে। এটুকু বলতে পারি, সেই প্রশাসন আলাদা থাকবে। সেখানে মণিপুর পুলিশ থাকবে না। ওদের কম্যান্ডো থাকবে না।’
মেইতেই এলাকায় কুকিদের এবং কুকি এলাকায় মেইতেইদের প্রবেশ নিষেধ। পুলিশ, প্রশাসন, অন্য যেকোনো পদের ক্ষেত্রে এই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা তো এখন থেকেই জারি করা আছে।
মোরে শহরের একটু আগে আসাম রাইফেলসের সবচেয়ে বড় চেকপোস্ট। এবার সেখানে গাড়ি থামিয়ে রাখা হলো এক ঘণ্টার মতো। তারপর অবশেষে ছাড়পত্র মিললো। বলা হলো, শহরের ভেতরে সেনার যে অফিসার আছেন তার কাছে আগে যেতে হবে। তিনি দুটি কথা বললেন। সেনা সদস্যদের ছবি তুলবেন না। সীমান্তে যাওয়া চলবে না। বাকি আপনারা ঘুরে দেখুন।
মোরে এমনিতে প্রাণবন্ত, জমজমাট একটা ছোট শহর। কিন্তু এই সংঘাতের পর দেখে মনে হচ্ছিল পুরো একটা মৃত নগরী। প্রধান বাজার এলাকায় চারপাশে পোড়া বাড়ির সারি। কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই সেখানে। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে দোকান-পাট সব। তবে বেছে বেছে দোকান ও বাড়িতে আগুন ধরানো হয়েছে। একটা স্টুডিওর লোহার গেট ভাঙা। ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুড়ে গেছে হার্ড ডিস্ক। প্রচুর আধপোড়া আধার কার্ড ছড়িয়ে। ভাঙা কম্পিউটার পড়ে আছে একদিকে।
রাস্তায় কাঁটাতারের বেড়া। মাঝখানে একটা গাড়ি যাওয়ার মতো জায়গা ফাঁকা রাখা রয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সামনে পুলিশের একটি গাড়িতে অন্তত গোটা দশেক বুলেটের চিহ্ন। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসাম রাইফেলসের সদস্যরা। আর ঘুরছে কয়েকটা কুকুর-বেড়াল। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আসাম রাউফেলসের সুবেদার। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কী পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত? জবাব এলো, কার্ফিউ আছে বলে বুঝতে পারছেন না। কেউ বেরোতে পারছে না। নাহলে দেখতেন, উত্তেজনা কমেনি। বরং বেড়ে থাকতে পারে।
কথাটা নিখাদ সত্যি। একটু পরে মোরেতে কুকিদের নারী শাখার প্রধান আনচিনের কথা থেকেই বেরিয়ে এলো সেই উত্তেজনা। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা আর কিছুতেই এই প্রশাসন মানব না। এই পুলিশকে মানব না। এটা আমাদের জায়গা। তাহলে আমাদের জন্য কেন আলাদা প্রশাসন থাকবে না। এটা আমাদের অধিকার। তাহলে ভারতে আমরা কেন আমাদের অধিকার পাব না? কেন আমাদের মণিপুরের মধ্যে থাকতে হবে? মণিপুরের থেকে আমরা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চাই। ওদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখব না। আমাদের জমিতে আমাদের এই অধিকার না দিলে আমরা থামব না।’
বুঝা যাচ্ছিল, আসাম রাইফেলসের সুবেদার ভুল কিছু বলেননি। উত্তেজনা কম নয়, বরং বেড়েছে।
মোরেতে ঘুরলেই দেখতে পাবেন, অনেক মোটরবাইক, স্কুটিতে নাম্বারপ্লেট নেই। সেগুলি যে কোম্পানির তা ভারতের অন্য জায়গায় দেখবেন না। কেন এরকম নম্বরহীন বাইক থাকবে? জবাবটা দিলেন আমাদের গাড়ির চালক আরিফ। পাশেই মিয়ানমার। সেখানে ভারতীয় নম্বর প্লেটের যান চলবে না। তাই নাম্বারপ্লেটই নেই। তাহলে ঝামেলাও নেই। মিয়ানমারেও এই দ্বিচক্রযান চালাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আর অধিকাংশ বাইক, স্কুটিও মিয়ানমারে তৈরি। ফলে অবাধ যাতায়াতের একটা গল্প এখানে ভালোভাবেই থাকছে।
ইম্ফলে অনেকবার এই অভিযোগ শুনেছি, কুকিদের সমর্থনে মিয়ানমার পেরিয়ে প্রচুর মানুষ আসছেন। আর আসছে মাদক।
প্রশাসনে থাকা অফিসাররাও জানিয়েছেন, মাদকের রুট হলো মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে পাহাড় থেকে উপত্যকায় নেমে ইম্ফল হয়ে আসাম। তারপর একটা অংশ চলে যায় বাংলাদেশে। অন্যটা দিল্লি হয়ে ভারতের অন্য জায়গায়।
মনে পড়লো ইম্ফলের এক আইএএস অফিসার বলছিলেন, গোয়েন্দারা আগে থেকে তথ্য না দিলে মাদক ধরা খুব শক্ত। কারণ, একটা ছোট সাবানের বাক্সে কয়েক শ’ কোটি টাকার মাদক এঁটে যায়। সব গাড়ি সার্চ করাও তো সম্ভব নয়। তাই আমরা নির্দিষ্ট তথ্য থাকলে সার্চ করি। কিন্তু মুশকিল হলো, আমরা তথ্যই পাই না।’ এই সংঘাতের পেছনে কী মাদকের ভূমিকা আছে? দু-পক্ষই তো একে অপরের দিকে এই অভিযোগ করছে। কথাটা শুনে তিনি শুধু হাসলেন। কিছুই বললেন না।
মেইতেইদের সাথে কথা বলুন, উঠে আসবে অনুপ্রবেশের অভিযোগ, মাদকের কাহিনি। কুকিদের সাথে কথা বলুন, একই অভিযোগ শুনবেন। মাদকের অভিযোগ। আর শুনবেন আসাম রাইফেলসের বিরুদ্ধে মেইতেইদের অভিযোগ এবং মণিপুরের পুলিশ ও কম্যান্ডোদের নিয়ে কুকিদের অভিয়োগ। সে প্রসঙ্গ পরের পর্বে।
শেষ করার আগে একটা তথ্য দেয়ার আছে। মোরেতে আমরা যেমন মেইতেইদের পোড়া বাড়ি দেখেছি। তেমনই দেখেছি কুকিদের ত্রাণশিবির। মেইতেই এলাকা থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন শিবিরে থাকা মানুষরা। বলেছিলাম না, সেই একই ছবি দুই জায়গায়। শুধু মানুষগুলো বদলে যায়। থেকে যায় একই অত্যাচারের কাহিনি, একই ক্ষোভ, একই অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্রের গল্প।
সূত্র : ডয়চে ভেলে