নিজস্বার্থে বাংলাদেশের কাছে ভারতের দীর্ঘদিনের অভিলাষ পূরণ, তৃপ্তির ঢেকুর

0

চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দরসহ চারটি ট্রানজিট রুট চূড়ান্ত অনুমোদন : ত্রিপুরার বাণিজ্যমন্ত্রীর উচ্ছ্বাস : সুবিধা বাড়ানোর তোড়জোড় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করার নয়া পরিকল্পনা ভারত-বাংলাদেশ-জাপান ‘ত্রিপক্ষীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নিয়ে আগরতলা সম্মেলন ও ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সে’র সমীক্ষা “ট্রানজিট ফিসমূহ ডলারে ধার্য হওয়াই অপরিহার্য ছিল। ডলারের পরিবর্তে টাকায় হওয়ায় প্রচ-ভাবে ভারতের স্বার্থানুকূলে গেছে। ভারতের সুবিধা হয়েছে বেশি। এরমধ্যে টাকার ২৫ শতাংশ অবচয়ন হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের পাওনাটা কম পাচ্ছি” -ড. মইনুল ইসলাম

ভারত নিজস্বার্থে বাংলাদেশের কাছে আবদার-অভিলাষ করে থাকে। ভারতের দীর্ঘদিনের অভিলাষ পূরণ হয়েছে সম্প্রতি ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধার মতো তাদের ‘মেগা অর্জন’ দিয়ে। তাও আবার চুক্তি অনুসারে ‘ভারতের পণ্যসামগ্রী ভারতেই পরিবহন’। মোট কথায় একতরফা ট্রানজিট-করিডোর। উদার বাংলাদেশ উজাড় করে মুঠো ভরে আবদার-আহ্লাদ পূরণ করছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে তার ছিটেফোঁটাও ‘বন্ধুত্বের বিনিময়’ আসছে না। এমনকি মিলছে না ন্যায্য পাওনাটাও। তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানি ভাগাভাগি, সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশী নিরীহ মানুষদের হত্যা বন্ধ করা, বাংলাদেশের প্রতিকূলে হিমালয়ের সমান বাণিজ্য ঘাটতি নিরসন, এদেশে উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের পণ্যসামগ্রী উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যের ভোক্তাদের মাঝে ব্যাপক চাহিদা পূরণে রফতানির প্রবেশাধিকার, অপর দুই নিকট প্রতিবেশী নেপাল ও ভুটানে রফতানি ও কম মূল্যে আমদানির সুযোগ, এ দু’টি দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, শিলিগুঁড়ির সংলগ্ন কড়িডোর (চিকেন নেক) সুবিধার চারদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান) পরস্পর বাণিজ্যিক সহযোগিতামূলক ব্যবহারর অঙ্গীকার ও চুক্তি বাস্তবায়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, অমীমাংসিত বিষয় বা সমস্যা-সঙ্কট আটকে আছে দীর্ঘকাল। ঝুলে আছে অনিশ্চিত অবস্থায়।

অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনের লক্ষ্যে প্রধান চারটি ট্রানজিট রুট অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ তথ্য জানিয়ে সম্প্রতি ত্রিপুরার বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তনা চাকমা এক সংবাদ সম্মেলনে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। ট্রানজিট-করিডোর সুবিধার মতো বিরাট অর্জনে ভারত তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। এহেন ‘অর্জন’কে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মহল ও জনগণের মাঝে তুলে ধরছে। সাফল্যের উদযাপন করছে। ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআই গত ৪ আগস্ট এক প্রতিবেদনে জানায়, ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তনা চাকমা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। তা হলো ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী পরিবহন করতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকার পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চারটি রুট অনুমোদনের কথা জানিয়েছে। রুটগুলো হলো, চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলা বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।

প্রসঙ্গত দৈনিক ইনকিলাবে গত ২১ মে ২০২৩ইং ‘ভারতের লাভ চার গুণ : কেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধাদান : কোন রুট দিয়ে ভারতের কত সাশ্রয়Ñ কী রিপোর্ট ছিল ট্যারিফ কমিশন কোর কমিটির’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ভারতের পণ্য পরিবহন সুবিধা সম্বলিত বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট-করিডোর ব্যবস্থার চুক্তি পুরোদমে কার্যকর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তিটির শিরোনামেই উল্লেখ রয়েছেÑ ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ চুক্তি অনুসারে ভারতের পণ্য যাবে ভারতেই। যা একতরফা, একমুখী ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা। কেননা এ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের কোন পণ্যসামগ্রী ভারতে রফতানি হচ্ছে না। চুক্তিতেও তা নেই।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিট সুবিধা অনুমোদন দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ কার্যকর করে গত ২৪ এপ্রিল’২৩ইং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদেশ (এসআরও) জারি করে। অবশেষে সরকার তা চুড়ান্ত অনুমোদন করেছে। চুক্তি কার্যকর সংক্রান্ত আদেশে সমুদ্রবন্দরে জাহাজ ভিড়া, ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের ঘোষণা, পণ্যের পরীক্ষা, ট্রানজিট সময়কাল, ডেলিভারি পরিবহন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়। সেখানে দেশীয় পণ্য আমদানি-রফতানিকারকদের চেয়ে ভারতের ট্রানজিট পণ্যসামগ্রী বন্দরে খালাসে দ্রুততা এবং মজুদ রাখার ক্ষেত্রে বেশি সময়-সুযোগ, ফ্রি-টাইম দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের উভয় আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর ও কাস্টমস চট্টগ্রাম এবং মোংলা। সেই আন্তর্জাতিক বন্দর-শিপিংয়ে প্রচলিত ট্রানজিট আমদানি ও রফতানি চালানে ফি, শুল্কায়ন, মাশুল, চার্জ, ভাড়া ইত্যাদি ডলারে ধার্র্য্য করা হয়নি চুক্তিতে। এর পরিবর্তে ‘টাকা’য় নির্ধারণ করা হয়েছে। তাও মামুলি নামেমাত্র ফি-চার্জ-মাশুল। এ বিষয়ে বিভিন্ন মহলে আছে আলোচনা-সমালোচনা। বলা হচ্ছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল বলছেন, এ বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে কমার্শিয়ালি দেখা হচ্ছে না। নিকটতম প্রতিবেশী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিরিখে দেখা হচ্ছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ফি-চার্জের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বন্দর-শিপিং বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ট্রানজিটের ফি মাশুল চার্জ ইত্যাদি ডলারে নির্ধারণ করাই যৌক্তিক ও অপরিহার্য ছিল। কিন্তু ডলারের পরিবর্তে টাকায় ধার্য্য হওয়ায় এই ট্রানজিট ব্যবস্থায় লাভালাভ প্রচ-ভাবে ভারতের স্বার্থানুকূলে গেছে। ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট বাবদ বাংলাদেশের জন্য যে চার্জ নির্ধারণ হয়েছে সেটি আরো বেশি হতে পারতো। আয়ও বেশি হতো। তিনি বলেন, টাকায় হওয়াতে ভারতের সুবিধাই হয়েছে বেশি। অথচ এসব ফি মাশুল চার্জ বাবদ বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। তা হয়নি। এর মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার ২৫ শতাংশ অবচয়ন হয়েছে।

ডলারে হলে তাহলে সময়ে-সময়ে টাকার অবচয়ন হলেও সমস্যা ছিল না। অর্থাৎ এভাবে আমরা আমাদের পাওনাটা কম পাচ্ছি। বন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় ভারতের যদি একশ’ ডলার বেঁচে যায়, আমাদের সেখানে পঞ্চাশ ডলার দেয়া হোক, ওরা পঞ্চাশ রাখুক। কিন্তু ভারত যদি ৮০ বা ৮৫ ডলারই নিয়ে যায়, আমাদেরকে ১৫ বা ২০ ডলারের সমান সুবিধা দেয়, সেটা আমি সমতা ও ন্যায্য মনে করিনা। ট্রান্সশিপমেন্ট ফি, চার্জ-মাশুল পুনর্মূল্যায়ণ করা প্রয়োজন।

তবে ড. মইনুল ইসলামের অভিমত, বাংলাদেশ ভারতকে বিভিন্ন রুটে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও ঐ রুটগুলোর ব্যবহার এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যায়নি। বিজেপি দলের শাসিত আসাম, ত্রিপুরায় বাংলাদেশ-বিরোধী সেন্টিমেন্ট জোরদার হওয়ায় হয়তো ট্রানজিট সুবিধা তেমন একটা ব্যবহৃত হচ্ছে না।

ট্রানজিট সুবিধা বৃদ্ধির তোড়জোড় : বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধার মতো মেগা অর্জনে ভারতের নেতা-মন্ত্রী, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মাঝে তৃপ্তির ঢেঁঁঁকুরের পাশাপাশি সুবিধা আরো বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মহেশখালীতে জাপানের সহযোগিতায় নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে ভারতের বন্দর-বিহীন স্থলবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করার নয়া অভিলাষ ও পরিকল্পনা সাজাচ্ছে ভারত। উত্তর-পূর্ব ভারতকে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশ-জাপান ‘ত্রিপক্ষীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নিয়ে আগরতলায় অনুষ্ঠিত এক ত্রিদেশীয় বৈঠকে এ বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআই’র প্রতিবেদনে একথা জানা গেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত এপ্রিল মাসে (১১-১২ এপ্রিল) উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশে ত্রিপক্ষীয় এক সম্মেলনে অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত ও জাপান। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’ এ বৈঠক আয়োজন করে।

এর আগে সমীক্ষা পরিচালনা করে ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’। তার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাণিজ্য সহজীকরণে ভারত-বাংলাদেশকে এক লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা-নেয়া সহজ করতে দ্রুতগতিতে যান চলাচল উপযোগী সড়কপথ নির্মাণ করতে হবে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ ছাড়াও জাপান বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও বিনিয়োগ করেছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের দিয়ে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত হবে।

এর আগে মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে বাংলাদেশ ও ভারতে নতুন সিস্টার শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে জাপান। যেখানে মূলত নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রফতানির জন্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হবে। গত মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ভারত সফরকালে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে এই শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং জাপান, ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রস্তাব উঠে আসে বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ভারত ও জাপানি গণমাধ্যমেও এ বিষয়টি ফলাও প্রচার হয়ে আসছে।

উৎসঃ   ইনকিলাব
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More