ঢাকা: ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলায় আগামী ২১ আগস্টের মধ্যেই রায় এবং আসামিদের সাজার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান। বুধবার তিনি বাংলামেইলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ আশাবাদ ব্যাক্ত করেন।
যে গতিতে মামলার কার্যক্রম চলছে তাতে কবে নাগাদ এই মামলার রায় হতে পারে?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: এটা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে যে গতিতে মামলার কার্যক্রম চলছে তাতে আশা করছি আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় এই মামলাটির একটা বিচার নিষ্পত্তি হতে পারে।
মামলায় এ পর্যন্ত যতজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলেন তাতে কি আসামিদের সাজা হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: দেখুন, সাজা হওয়া না হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে বিচারকের উপর। তবে মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনিত ও গঠিত অভিযোগ, রাষ্ট্রপক্ষে আমাদের বক্তব্য মামলার আলামত, এ পর্যন্ত সম্পন্ন সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের পক্ষে সাক্ষীদেরকে করা জেরার ধরনের উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি যে, আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছি। সাক্ষ্য ও জেরার এই গতি প্রকৃতি অব্যাহত থাকলে আমরা আসামিদের সাজার ব্যাপারে আশা করতে পারি।
২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডির পরিদর্শক ফজলুল কবির যে চার্জশিট দেন তাতে তারেক রহমানের নাম ছিল না। কিন্তু ২০১২ সালের ১৮ মার্চ দ্বিতীয় দফায় তারেক রহমানসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার বিষয়টিকে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলা যায় না?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: সম্পূরক চার্জশিটে যাদের নাম আছে তদন্তের মাধ্যমেই এসেছে। নতুন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে বলেই তদন্ত কর্মকর্তা তাদের নামে চার্জশিট দিয়েছেন। গ্রেনেড হামলার আগে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং হয়েছে, হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে মিটিং হয়েছে। ওইসব মিটিংয়ে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে এবং তাদের আশ্বাসে ও সার্বিক সহায়তায়ই এ বর্বরোচিত হামলা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে এতে। যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের নামে চার্জশিট দেয়াটাকে কোনো বিবেচনাতেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলা যাবে না। বরং যারা এটা বলেন তারাই রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বহু নিরপরাধ মানুষকে আহত ও হত্যার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তাদের এ বক্তব্য সত্যের অপলাপ।
এ মামলায় বিচারকার্য শম্ভূক গতিতে চলছে বলে অনেকে মনে করেন- এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
সৈয়দ রেজাউর রহমান: এটা একটা বড় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলা। এ মামলার আসামিদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। এদের কেউ কেউ দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায়, কেউ কেউ সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর বোমা হামলা মামলায়, কেউ রমনা বোমা হামলা মামলায়, আবার কেউ কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা হামলা মামলায় আসামি। এসব আসামিদেরকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান মামলা মোকদ্দমায় ধার্য তারিখে হাজির করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সকল আইনগত বিধি বিধান মেনে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে চাইলেও এর চেয়ে দ্রুত গতিতে বিচার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বলা যায় অসম্ভব।
এরপর তিনি স্বাভাবিক আলাপচারিতায় আরো বলেন, ‘কত মানুষের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে এই হামলায়। কত মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। কত মানুষ এখনো স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। মেয়র হানিফ কত স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তার কথা কয়জন জানে। সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভী রহমান অকাতরে জীবন দিয়ে গেলেন।’
শেষে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে চিরতরে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য, শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্যই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জনসভায় সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায়। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নির্মমভাবে নিহত হন। সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। আহত হন শতাধিত নেতাকর্মী।
এ ঘটনায় বুধবার তৎকালীন মতিঝিল থানার এসআই এবং জব্দ তালিকার প্রস্তুতকারক মিজানুর রহমান খন্দকারের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। জবানবন্দী প্রদান শেষে আসামিপক্ষে তাকে আংশিক জেরাও করেন আইনজীবীরা। জবানবন্দী ও জেরা গ্রহণ করেন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শাহেদ নুর উদ্দিন।
এ মামলার ৪৯১ সাক্ষীর মধ্যে এ নিয়ে ৯৮ জন পরিপূর্ণভাবে ও ৯৯তম সাক্ষীর সাক্ষ্য আংশিক শেষ হয়েছে। এ মামলায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের কথা গত ২০ মে ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ মনিরুল ইসলামের সাক্ষীতে উঠে এসেছে।
ওইদিন তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জবানবন্দীতে বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনাকারী ও গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনকে আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) তত্ত্বাবধায়নে বাদল নাম দিয়ে ভুয়া পাসপোর্টে পাকিস্তান পাঠানো হয়।’
তিনি জবানবন্দীতে আরো বলেন, ‘২০০৬ সালে ঢাকা ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবিতে তিনি যোগদান করেন। তাদের দায়িত্ব ছিল সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে তথ্য সংগ্রহ করা। ২০০৫ সালের অক্টোবরে র্যাবের হাতে আটক হন মুফতি হান্নান। তাকে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।’
জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি হান্নান জানান, হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ছোটভাই মাওলানা তাজউদ্দিন সরবরাহ করেন।
এমন তথ্য পাওয়ার পর ২০০৬ সালের অক্টোবরে মাওলানা আব্দুস সালাম ও মাওলানা তাজউদ্দিনকে ডিজিএফআইয়ের কার্যালয়ে আনা হয়। ডিজিএফআইয়ের সেফ হোমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন, লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
জিজ্ঞাসাবাদের পর লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন মোবাইলে কিছুক্ষণ আলাপ করেন। পরে এসে তারা পরস্পর বলাবলি করেন মাওলানা তাজউদ্দিনকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছেন।
জবানবন্দীতে মেজর মনির আরো বলেন, এর দুইদিন পর মাওলানা তাজউদ্দিনের ছবি দিয়ে ‘বাদল’ নামে একটি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশ বিমানে করাচি যাওয়ার টিকিট এবং বোর্ডিং কার্ড তার হাতে দেন লে. কর্নেল সাইফুল জেয়ারদার। তার সঙ্গে লে. কমান্ডার মিজানকে তাজউদ্দিনকে বিমানে তুলে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। বিমানবন্দরে ডিজিএফআইয়ের লোকদের সহায়তায় তাকে করাচিগামী বিমানে তুলে দেন তারা। তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারা এসব কাজ করেছিলেন বলে সাক্ষীর জবানবন্দীতে তিনি বলেন।
এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণকালে জামিনে থাকা আসামি খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে হাজির থাকেন।
এছাড়া সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ জনকে জেলহাজত থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বর্তমান বিএনপির এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ আসামি পলাতক আছেন।
এ ঘটনায় মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় পৃথক ৩টি এজাহার দায়ের করেন।
মামলাটিয় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান।
>> বাংলামেইল২৪ডটকম