আহারে, তোমার বাচ্চা হচ্ছে না?

0

অযথা সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে কাউকে বিব্রত করা উচিত না। মডেল: সঞ্জয়, তাসনিম ও রিপা। ছবি: সুমন ইউসুফ
অযথা সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে কাউকে বিব্রত করা উচিত না। মডেল: সঞ্জয়, তাসনিম ও রিপা। ছবি: সুমন ইউসুফ

ইদানীং বিয়ে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী-জাতীয় কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন রুমানা (ছদ্ননাম)। দেখা হলেই আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ীরা সন্তান না হওয়া নিয়ে জানতে চান। কেউ কেউ নানা রকম চিকিৎসার পরামর্শও দেন। কেউ কেউ সান্ত্বনা দেন—বেশি ভেবো না, আমার অমুক আত্মীয়া বা তমুক বান্ধবীর তো বিয়ের ১২ বছর পর সন্তান হয়েছে। কেউ কেউ সহানুভূতি জানাতে ভোলেন না—এ নিয়ে বেশি মন খারাপ করতে নেই, সৃষ্টিকর্তা যখন দেননি তখন আর কী করা! হয়তো চারপাশের সবাই রুমানার প্রতি সহানুভূতিশীল; তাঁর মা হতে না পারার কষ্টে সমব্যথী হতে চান—রুমানা এটা বোঝেন। তবু এই সমবেদনা আর সহানুভূতির ভার তাঁর সহ্য হতে চায় না।

একটা সময় ছিল, যখন সন্তান না হওয়া বা বন্ধ্যা নারীকে এই সমাজে অন্যভাবে দেখা হতো। হয়তো তাঁকে কোনো শুভ কাজে অংশ নিতে দেওয়া হতো না, শিশুকে কোলে নিতে দিতেন না কেউ।
সময় পাল্টেছে। বর্তমানে বন্ধ্যত্বের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আছে, সেসব চিকিৎসায় ফলও হয়। আমাদের দেশেও সফলভাবে শুরু হয়ে গেছে টেস্টটিউব শিশু বা আইভিএফ, আইইউআই ধরনের অত্যাধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি। তাই বিয়ের পাঁচ-সাত বছর পরও সন্তান হয়নি যে নারীর, তাঁকে গালমন্দ করা হয় না বটে, তবে সদুপদেশ দিতে ছাড়েন না কেউ।
সন্তান না হওয়ার কষ্ট-বেদনা তো ব্যক্তিগত, একান্ত যে ব্যাপারটি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে কারোরই ভালো লাগে না। প্রায় আট বছর হলো চিকিৎসা করিয়েও মা হতে পারেননি এমন একজন নারী সুহানী রহমান বলেন, ‘কোলজুড়ে একটা শিশু না আসার বেদনা ও দীর্ঘশ্বাসটুকু কাউকেই বলে বোঝানো যায় না। এই দীর্ঘশ্বাসটুকু আমাদের স্বামী-স্ত্রীর একান্ত গোপন ও পরম বেদনার। কিন্তু পরিবারে, সমাজে, অনুষ্ঠানে এ নিয়ে যেকোনো ধরনের আলোচনা বা পরামর্শ আজকাল আরও বড় বেদনা বয়ে নিয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘মনটা সারাক্ষণ সংকুচিত হয়ে থাকে, মনে হয় সবাই আমাকে দেখলে এ কথাই যেন মনে করিয়ে দিতে চায়, তুমি মা হতে পারোনি, তুমি ব্যর্থ। আমি একেবারেই তা নিতে পারি না। হয়তো এটা আমারই সমস্যা। কিছু কিছু কষ্ট, কিছু কিছু অপ্রাপ্তি কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায় না।’
সুহানীর কথার প্রতিধ্বনি করেন আরেক দম্পতি। সাজেদ ও জিনিয়া (ছদ্ননাম)। এ ক্ষেত্রে পরামর্শগুলো স্ত্রীকেই বেশি শুনতে হয় বলে স্বীকার করলেন সাজেদুর রহমান। বন্ধুমহলে, আড্ডায়, সহকর্মীদের সঙ্গে কাজে তাঁকে হয়তো অহর্নিশি এসব কথা শুনতে হয় না, কিন্তু শুনতে হয় স্ত্রী জিনিয়াকে। এমনকি জিনিয়ার কাছের বন্ধুরাও বারবার এসব প্রসঙ্গ টেনে আনে বলে ইদানীং প্রায় সবাইকেই এড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন তিনি। তাঁরা কোথায়, কার কাছে চিকিৎসা করছেন বা করিয়েছেন, কী কী চেষ্টা ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছেন, সমস্যাটা কোথায় ইত্যাদি বিষয় যে তাঁদের দুজনের গোপন ও ব্যক্তিগত বিষয়, এগুলো যে অযাচিত আলোচনার বাইরের বিষয়—তা যেন কেউ বুঝতে চান না।

অন্যের ব্যক্তিগত গোপন বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা চর্চা করা, এমনকি নির্দোষ আলোচনা করাও কখনো কখনো ভদ্রতা বা সৌজন্যের সীমা পেরিয়ে যেতে পারে, কখনো হয়ে উঠতে পারে অন্যের জন্য বিব্রতকর বা কষ্টকর—এটা আমাদের বিবেচনা করা উচিত। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে অন্যের নাজুক বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ টেনে না আনাটাই উচিত। কিছু কিছু বিষয়ে অযাচিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত নাক গলানো নাহয় বন্ধই থাকল।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More