ডেস্ক রিপোট : পরিকল্পিত ফাঁদ পেতে আটক করা হয়েছে দৈনিক মানবজমিনের বিশেষ প্রতিনিধি চৌধুরী মুমতাজ আহমদকে। মঙ্গলবার দিনভর নানা নাটকীয়তার পর একটি সাজানো ঘটনায় মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সিলেটের এই জ্যেষ্ট সাংবাদিককে। সাজানো মামলায় তাকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়েছেন সিলেটের সাংবাদিক সমাজ। তাঁর মুক্তির দাবিতে সাংবাদিকরা থানা ঘেরাও ও রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন। রাতে সিলেটের সব সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা বৈঠক করে এ ঘটনায় ক্ষোভ-উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মুক্তি এবং তাকে আটকে নীল ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি নির্ধারণ করেছেন।
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ আটক, গ্রেফতারের পর আলোচনায় এসেছে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত তাঁর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। চৌধুরী মুমতাজ আহমদের নামে ২১ জুলাই মানবজমিন’র শেষপৃষ্ঠায় ‘এসএমপি’র গোলকধাঁধা হাওয়া কোনদিকে ঠাহর হচ্ছে না’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় ওই প্রতিবেদনটি।
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলছেন, ওই সংবাদ প্রকাশের কারণেই তিনি পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার রোষানলে পড়েন(!) এবং শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হন সাজানো মামলায়।
নিউজমিরর টোয়েন্টিফোর ডট কম’র পাঠকদের জন্য মানবজমিন এ প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
-বার্তা সম্পাদক
এসএমপি’র গোলকধাঁধা হাওয়া কোনদিকে ঠাহর হচ্ছে না
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, সিলেট থেকে । ২১ জুলাই ২০১৪, সোমবার, ১২:৫৪
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)-এ কখন কোন পালে হাওয়া বয় ঠিক ঠাহর করতে পারেন না অনেকেই। কখনও স্থানীয় কর্মকর্তাদের মনে আতঙ্ক জাগায় এসএমপির স্থানীয়দের বিরুদ্ধে ‘জিহাদের’ ঘোষণা। আবার যখন দেখেন স্থানীয় এক কর্মকর্তাকে ধরে রাখতে উপরের নির্দেশ মানছেন না বড়কর্তারা, তখন হিসাব মেলাতে পারেন না। প্রতিনিয়ত অসংখ্য রহস্য ভেদ করলেও এসএমপি’র পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের ঘরের রহস্য সন্ধান করতে পারেননি।
এসএমপির বিরুদ্ধে স্থানীয়বিরোধী জিহাদের অভিযোগ ওঠে ২০১৩ সালের নভেম্বরে। তালিকা প্রস্তুত করা হয় ১৫১ জনের। জামায়াত কানেকশনের অভিযোগ তুলে তাদেরকে এসএমপি থেকে বদলির উদ্যোগ নেয়া হয়। বিষয়টি সে সময় পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশ হয়েছিল। জানাজানি হলে এ উদ্যোগ থেকে সরে আসে এসএমপি। তবে একেবারে মাটিচাপা দেয়া হয়নি এ উদ্যোগকে। কৌশলী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকে ‘শুদ্ধি অভিযান’। পরিকল্পিতভাবে বদলি হতে থাকেন একের পর এক স্থানীয় কর্মকর্তা। বছরের শুরুতে সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকায় ৬ থানার ৫টিতেই ওসির দায়িত্বে ছিলেন সিলেট বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারাই। বছরের অর্ধেক পেরোনোর আগেই থানার বড়কর্তার পদ থেকে তিনজনকে সরে যেতে হয়েছে। গুঞ্জন রয়েছে খুব শিগগিরই হয়তো বাকি দুই থানা থেকেও সরে যেতে হতে পারে স্থানীয় ওসিদের। এমন হলে এসএমপির থানাগুলোর বড় কর্তার চেয়ারে আর দেখা যাবে না সিলেটের কাউকে।
সিলেটবিরোধী অভিযানের বিপরীতে একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে আছেন কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) শ্যামল বণিক। উপর মহলের নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে তাকে কোতোয়ালি থানাতেই ধরে রাখা হয়েছে। তবে এসএমপি’র একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, ‘শুদ্ধি অভিযানে’র তালিকায় ছিলেন হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বাসিন্দা শ্যামল বণিক। এসএমপির সুপারিশের ভিত্তিতেই পুলিশ হেড কোয়ার্টার গত ১০ই মার্চ তাকে সিলেট রেঞ্জে বদলি করে। কিন্তু কি এক মন্ত্রবলে এসএমপির বড়কর্তাদের ম্যানেজ করে নেন শ্যামল বণিক।
এক উপ-কমিশনারের সুপারিশসহ আদেশ বাতিলের আবেদনে পাঠানো হয় হেড কোয়ার্টারে। সে আবেদন নাকচ করে দেয় পুলিশের মূল কার্যালয়। আদেশ দেয় স্ট্যান্ড রিলিজের। প্রায় ৪ মাসেও সে আদেশ কার্যকর হয়নি। শ্যামল বণিক এখনও কোতোয়ালি থানার ওসির (তদন্ত) দায়িত্বে আছেন।
থানা থেকে স্থানীয় ওসি বদলের ধারাবাহিকতার শুরু ফেব্র“য়ারি মাসে। শাহপরান থানার ওসি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচঙের বাসিন্দা শিবেন্দ্র কুমার দাস উপরের নির্দেশে ৭ই ফেব্র“য়ারি দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন বরিশালের সাখাওয়াত হোসেনকে। শিবেন্দ্র দাসকে সরে যেতে হয় মহানগর গোয়েন্দা বিভাগে। ২ মাস বিরতির পর একে একে আরও দুই থানা বিদায় নিতে হয় স্থানীয় দুই ওসিকে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাসিন্দা আখতার হোসেনকে ২৪শে মে বিমানবন্দর থানার ওসির চেয়ার ছাড়তে হয়। এখন আছেন ওসমানী বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে। তার জায়গায় দায়িত্ব পেয়েছেন সদ্য পরিদর্শক পদে উন্নীত হওয়া শাহজামান, যার বাড়িও বরিশালে।
শিবেন্দ্র দাস ও আখতার হোসেনের মতো সরাসরি সরানো হয়নি দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি রঞ্জন সামন্তকে। স্থানীয় ওসিদের বদলির বিষয়টি যাতে চোখে না লাগে সে জন্য সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বাসিন্দা রঞ্জন সামন্তের বেলায় নেয়া হয় কৌশলী আশ্রয়। ‘চোখ ধোলাইয়ের’ জন্য তাকে দেয়া হয় দুঃসাধ্য এক আল্টিমেটাম। দুদিনের মধ্যে পুরো দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকাকে মাদকমুক্ত করার আল্টিমেটাম পূরণে ‘ব্যর্থ’ হওয়ায় ২৯শে মে রঞ্জন সামন্তকে বদলি করা হয় পাশের থানা মোগলাবাজারে। দক্ষিণ সুরমা থানার দায়িত্ব পান মোগলাবাজার থানার ওসি মোহাম্মদ মুরসালিন।
চোখ ধোলাই বা আইওয়াশের পর এবার আসল মিশনে নামে এসএমপি। মোগলাবাজার থানায় ৫ দিনের বেশি দায়িত্ব পালনেরও সুযোগ পাননি রঞ্জন সামন্ত। এসএমপি থেকে তার বিদায় ঘণ্টা বাজে। ৪ঠা জুন আদেশ আসে বদলির। পোস্টিং হয় বরিশালে। চেষ্টা তদবিরের পর অবশ্য সেটা তিনি পাল্টিয়ে নিয়েছেন চট্টগ্রামে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার মতো কেউ না থাকলেও রঞ্জন সামন্তকে মোগলাবাজার থানা ছাড়তে হয়। রঞ্জন সামন্তের জায়গায় যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তিনি তখন সিলেটেই ছিলেন না। মোগলাবাজার থানায় ওসি পদে দায়িত্ব পাওয়া শফিকুল ইসলাম তখন নোয়াখালীতে ৬ সপ্তাহ মেয়াদি প্রিলিমিনারি স্টাফ কোর্স ট্রেনিংয়ে। ট্রেনিং শেষে ২৯শে জুন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নতুন নিয়োগ পাওয়া ওসিদের কেউই সিলেটের বাসিন্দা নন। নিয়োগ পাওয়া তিনজনের দু’জনের বাড়িই বরিশালে, যে এলাকার বাসিন্দা এসএমপির বর্তমান কমিশনার শেখ মিজানুর রহমানও। অভিযোগ, শুধু বরিশালের বাসিন্দা হওয়ার কারণে অভিজ্ঞ অনেক ইন্সপেক্টরকে বাদ দিয়েই এ দু‘জনকে ওসি পদে পদায়ন করা হয়েছে।
তবে এসএমপি কমিশনারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কমর্র্কতারা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ইন্সপেক্টর সঙ্কটের কারণেই এ দু’জনকে ওসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যদিও তাদের এ বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি মানবজমিন-এর অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মহানগর গোয়েন্দা বিভাগে ৫ জন, এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে ৩ জন, মহানগর বিশেষ শাখা ও আদালতে ২ জন করে ইন্সপেক্টর দায়িত্বে রয়েছেন। এসএমপিতে বরিশালের কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার নজির রয়েছে আরও। শাহপরান থানার সহকারী কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা শাহীন মোল্লার বাড়িও বরিশালে।
নবীন কর্মকর্তারা ওসির দায়িত্ব পাওয়ায় এসএমপিতে অন্য এক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ওসি পদে নিয়োগ পাওয়া ইন্সপেক্টরদের চেয়ে জুনিয়র আর কোন ইন্সপেক্টর না থাকায় ওসি (তদন্ত) পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। শাহপরান, বিমানবন্দর ও মোগলাবাজার এ তিন থানাতেই শূন্য রয়েছে ওসি (তদন্ত) পদ। একা পুরো দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে থানার নতুন বড়কর্তাদের।
শুধু ওসি নয়, অন্য কর্মকর্তাদেরও এসএমপি থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কেবলমাত্র তাদের সিলেটি পরিচয়ের কারণে। স্থানীয়দের কাছে অপরাধীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে- এমন দোহাইয়ে আঞ্চলিকতার বিভাজন টানা হয়েছে এসএমপিতে। খোঁড়া অজুহাতে স্থানীয় কর্মকর্তারা বদলি হতে থাকেন।
এমন মিশনে সর্বপ্রথম শাস্তির খড়গ নেমে আসে এসএমপিতে সিলেটি কর্মকর্তা হিসেবে সবচেয়ে পরিচিত ও আলোচিত মুখ ইন্সপেক্টর শাহরিয়ার বিপ্লবের ওপর। স্থানীয়দের সতর্ক করতে প্রথম শিকার হিসেবে তাকেই বেছে নেয়া হয়। এরপর একে একে সরে যেতে হয় সাব ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান, সৈয়দ ইমরোজ তারেক, পরেশচন্দ্র, অভিজিৎ সিংহ, আমির হোসেন, আরজত আলী, বেনু চন্দ্রকে। এদের কেউ সিলেটছাড়া হয়েছেন, কেউবা আছেন ‘ক্লোজ’ হয়ে।