গরিব বলে কি বিচার পাব না, প্রশ্ন তনুর মায়ের

0

তিন মাসেও কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর খুনি শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর মা আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘গরিব বলে কি বিচার পাব না? এভাবে মেরে ফেলবে?’
গতকাল সোমবার কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে এক প্রতিবাদ সমাবেশে আনোয়ারা বেগম এসব কথা বলেন। তিনি অভিযোগ করেন, তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেনকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
তনু হত্যার তিন মাস উপলক্ষে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে গণজাগরণ মঞ্চ, কুমিল্লা জেলা শাখা। বেলা ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত এ সমাবেশ হয়। গত ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনু খুন হন। ওই রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতর একটি ঝোপ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করেন বাবা ইয়ার হোসেন।
সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তনুর মা আনোয়ারা বেগম। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে গতকাল সমাবেশ করে কুমিল্লা গণজাগরণ মঞ্চ l ছবি: প্রথম আলোআনোয়ারা বেগম বলেন, ‘তনুর বাবাকে কথা বলতে না করেছে ওরা। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলি না। সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য আমার মেয়েকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বলি। আমাদের পাহারা দেয় ওরা, আমরা কোন খান দিয়া আডি (হাঁটি)। আমার বড় ছেলে ভয়ে ঢাকা থেকে আসে না। মিডিয়ার সামনে কথা বললে ওরা আমাদের বাসায় থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয়। আমি বলছি, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে যাব।’ তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী মেয়ের সব স্মৃতি নিয়ে গেছে। ডায়েরি নিয়ে গেছে। ডায়েরির সব পাতা কাইট্টা রাইক্কা দিছে। বাসা থেকে অ্যালবাম নিয়ে গেছে। একটা ছবিও ফেরত দেয়নি, যা দেখে কাঁদব।’
আনোয়ারা বেগম অভিযোগ করেন, ‘সিআইডি সেনাবাহিনীর তিনজনকে যেদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে, সেদিন ওর (তনুর) বাবাকে মারার চেষ্টা করা হয়। ওর বাবার শরীরের ওপর প্রথমে গাড়ি এবং পরে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে। ওকে মারার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তনুর মায়ের অভিযোগ সম্পর্কে সেনা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে ঢাকায় আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক রাশিদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তনুর মা যেসব অভিযোগ করেছেন, তা ভিত্তিহীন। বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। তনুর মা তাঁর অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থাকে জানাতে পারেন। তদন্তকারী সংস্থা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে পারে।
দুই দফা তনুর লাশের ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করতে না পারায় আনোয়ারা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এর নেপথ্য কারণ বের করতে ময়নাতদন্তে যুক্ত চিকিৎসকদের তদন্তের আওতায় আনার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘ডাক্তারদের আইনের আওতায় আনা হোক। ডাক্তার মিথ্যা কথা বলল কেরে (কেন), ডাক্তার কিছু লেখছে না। হত্যাকারীদের সঙ্গে ডাক্তাররা জড়িত। তাহলে কেন তাদের রক্ষা করল? সিআইডি তাড়াতাড়ি আসামি ধরে না কেরে?’[ads1]
তনুর মা বলেন, ‘স্ট্রোক করলে রাস্তার পাশে পড়ে থাকত আমার মেয়ে। জঙ্গলের ভেতরে মেরে ফেলে রাখবে কেন? আমার মেয়ে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি ছিল, তাঁরা বলে, পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। তাঁরা আমার মাইয়ারে মাইরা আইন্যা ফালাইছে জঙ্গলে। আমারে বলল, জুতা পাইয়া বাসায় আইলেন না কেন? জঙ্গলে খুঁজতে গেলেন কেন? আমার মাইয়া আরাইছে (হারিয়েছে), আমি খুঁজব না, কে খুঁজবে?’
বক্তৃতার একপর্যায়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তনুর মা। তিনি বলেন, ‘আমার শ্বশুর বলছেন, নাতিন এখনো মরে নাই। তাঁর বিশ্বাস, তনু ফিরে আসবে। নাতিনের শোকে তিনি অসুস্থ।’ বলতে বলতে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন আনোয়ারা। মাইক্রোফোনে কথা বলা বন্ধ করে দেন। পুরো সমাবেশ স্তব্ধ। দুই মিনিট পর তিনি আবার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদলেন। এ সময় সমাবেশ ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়ানো নারী-পুরুষকেও কাঁদতে দেখা যায়।
কান্না শেষে তনুর মা বললেন, ‘আমি খুনিদের বিচার চাই।’
প্রতিবাদ সমাবেশে স্লোগান ওঠে, ‘তনুর মা কাঁদছে কেন, প্রশাসন জবাব চাই’।
গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লা জেলার মুখপাত্র আবুল কাশেম বলেন, তিন মাস পেরিয়ে গেছে। এখনো তনুর খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। দেশবাসী খুনিদের আইনের কাঠগড়ায় দেখতে চায়।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক পরেশ রঞ্জন কর, মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন, তনুর ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন, লেখক মোতাহার হোসেন, কুমিল্লা গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র আবুল কাশেম ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক খায়রুল আনাম, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের সাবেক সভাপতি ইকরামুল হাসান।
তনু হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছে সিআইডি। তাঁর লাশের দুই দফা ময়নাতদন্ত করেও মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারেননি চিকিৎসকেরা। দুটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়েই বিতর্ক এবং সত্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে। সিআইডি বলছে, তনুর শরীর ও পরনের কাপড়ের নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তাতে পৃথক তিন ব্যক্তির বীর্য পাওয়া গেছে। ওই তিন ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইলও তৈরি করা হয়েছে।
আর তনুর মা গত ১০ মে সিআইডি ও গণমাধ্যমকে সন্দেহভাজন হিসেবে দুই সেনাসদস্যের নাম বলেছেন, যাঁরা তনুকে ওই দিন বিকেলে ডেকে নেন। এরপর তনু আর ফিরে আসেননি।
এরপর এক মাসের বেশি সময় পার হয়েছে, এখন পর্যন্ত এই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ডিএনএর সঙ্গে তনুর দেহে পাওয়া ডিএনএর নমুনা মেলাতে সক্ষম হয়নি সিআইডি। এ নিয়ে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখন আর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন।
এর আগে ১৪ জুন এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমাদের বলা হচ্ছে নিশ্চিত হয়ে ডিএনএ মেলানোর জন্য। যদি নিশ্চিতই হতাম, এই হত্যায় কে বা কারা জড়িত, তাহলে তো তাদের ধরেই ফেলতাম।’[ads2]

সূত্র ঃ photom alo

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More