দেশের টাকা লুটপাট করে শেখ হাসিনা পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বিদেশে। শেখ হাসিনার শাসনকালে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা লুটে নিয়েছে দেশের সম্পদ। ঋনের নামে ফতুর করেছে দেশের সব ব্যাংক। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন, শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান ফজলুর রহমান ওরফে সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া হিসাবে পরিচিত বেসরকারি কোম্পানি সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম।
শেখ পরিবারের আশীর্বাদপুষ্ঠ হিসাবে পরিচিত এই ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীরা দেশের সম্পদ লুটপাট করে দেশে-বিদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। শোনা যায়, দেশ থেকে লুটে নেওয়া শেখ পরিবারের সম্পদও রয়েছে তাদের কাছে।
এই প্রতিবেদনে সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান ও এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের প্রদর্শিত সম্পদের এক ঝলক হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরেও হাজার-হাজার কোটি টাকা অ-প্রদর্শিত সম্পদ রয়েছে এই দুই ব্যবসায়ীর।
সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম:
পরিবহন ব্যবসায়ে হাতেখড়ি। শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত এই ব্যবসায়ী যেন আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছে আওয়ামী আমলে। শেখ পরিবারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে একে একে ৭টি ব্যাংকের মালিকানা কব্জায় নেয় এই ব্যবসায়ী।
শেখ হাসিনার গত চৌদ্দ বছরের দুঃশাসনে শেখ পরিবারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রথমে দখল করে নেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক শতাব্দী পুরাতন অর্থনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘দ্য ব্যাংকার’ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে বিশ্বের ১,০০০ শীর্ষ ব্যাংকের তালিকায় একমাত্র ও প্রথম বাংলাদেশী ব্যাংক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ছিল ২০,০০০ মিলিয়ন টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৬,৬৩৬.২৮ মিলিয়ন টাকা।
শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে এস আলম কর্তৃক ব্যাংকটি দখলে নেওয়ার পর প্রত্যেকটা স্তরে আওয়ামী দুর্বৃত্তদের বসিয়ে ব্যাংকটিতে চালানো হয় ব্যাপক লুটপাট। হাজার-হাজার কোটি টাকা গায়েবী ঋণ নিয়ে ব্যাংকটিকে কার্যত ফোকলা করে ফেলে এস আলম ও আওয়ামী লীগের লোকজন।
সিঙ্গাপুরে এস আলমের সোয়া দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ:
লুটপাটের টাকায় ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরে সোয়া দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন এস আলম।
সিঙ্গাপুরের একটি প্রভাবশালী পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিটল ইন্ডিয়া এলাকায় সেন্ট্রিয়াম স্কয়ার নামের একটি বাণিজ্যিক ভবনে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ সিঙ্গাপুরী ডলার বা ৭৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন এস আলম গ্রুপ। এ ছাড়া দুই বছর আগে ২৪ কোটি ৮০ লাখ সিঙ্গাপুরী ডলার বা এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকায় একই এলাকায় একটি হোটেলও কেনে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম চার হাজার ৯৬৭ সিঙ্গাপুরী ডলার বা দুই লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এই দামে ভবনটির নিচের দুটি তলায় ২৭ হাজার ১৭৯ বর্গফুট জায়গা বা ৪৯টি ইউনিট কিনেছে এস আলম গ্রুপ।
ক্যানালি লজিস্টিকস নামের সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটি মোহাম্মদ সাইফুল আলমের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এই ক্যানালি লজিস্টিকসের নামে ২০১৪ সালে সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়া এলাকার বেলিলিওস সড়কের গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর হোটেলটি অধিগ্রহণ করা হয়। যার অধিগ্রহণ মূল্য ছিল ২৪ কোটি ৮০ লাখ সিঙ্গাপুর ডলার বা প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর হোটেলটি গ্র্যান্ড ইম্পিরিয়াল হোটেল নামে পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া, আলফা ইনভেস্টমেন্ট পার্ট-নার্স সিঙ্গাপুরের নোভেনা এলাকার একটি ২৪১ কক্ষবিশিষ্ট একটি হোটেল ১৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (১২৫.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) দামে ২০১৯ সালে কিনেছে এস আলম গ্রুপ।
অথচ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির পক্ষে বিদেশে পুঁজি বা মূলধন স্থানান্তরের সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে থাকা এই ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে টাকা পাচার করেছে বিদেশে। গড়েছে সম্পদের পাহাড়।
সামিট গ্রুপের আজিজ খান:
শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খান।
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস ২০২২ সালে এশিয়ার নিরাপদ স্বর্গ হিসাবে পরিচিত সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতের ৪২ নম্বরে রয়েছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি কোম্পানি সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান।
বাংলাদেশি নাগরিক আজিজ মুহাম্মদের সিঙ্গাপুরে ব্যবসা রয়েছে। দেশটিতে এক যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন তিনি।
বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করে দেশের টাকা নিংড়ে নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন শেখ পরিবারের আশির্বাদপুষ্ট এই ব্যবসায়ী। বিদ্যুৎ না দিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এই প্রতিষ্ঠান লুটে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় তহবিলের হাজারো কোটি টাকা। এই টাকা তারা পাচার করেছে বিদেশে।
মুহাম্মদ আজিজ খানের প্রোফাইলে ফোর্বস লিখেছে, মুহাম্মদ আজিজ খান প্রথমবারের মতো সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় জায়গা পেয়েছিলেন ২০১৮ সালে। এরপর ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো তিনি সিঙ্গাপুরের বিলিয়ন ডলারের ক্লাবে ঢুকে পড়েছেন। ২০১৮ সালে তার সম্পদের পরিমাণ ৯১ কোটি মার্কিন ডলার ছিল। আর কয়েক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে এ বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে।
মুহাম্মদ আজিজ খান বিদ্যুৎ কোম্পানি সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান। সামিটের বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস এবং রিয়েল স্টেট ব্যবসা রয়েছে। ২০১৯ সালে জাপানের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেরা মুহাম্মদ আজিজ খানের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। যে কারণে ওই বছর তার সম্পদের পরিমাণ কমে যায়।
ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, মুহাম্মদ আজিজ খানের কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত। বর্তমানে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন আজিজ খানের মেয়ে আয়েশা। বাংলাদেশেও এই কোম্পানির ব্যবসা রয়েছে। তবে সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত হওয়ায় এর সম্পদের হিসেব-নিকেশ সেখানেই হয়।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিষ্টস (আইসিআইজে) ২০১৬ সালে বিশ্বজুড়ে কর ফাঁকির ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস করেছিল।
বিশ্বজুড়ে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত আইসিআইজের কর ফাঁকির সেই তালিকায় সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান ও তার পরিবারের নামও পাওয়া যায়।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ফারুক খানের ভাই মুহাম্মদ আজিজ খান। সরকারের ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে বাণিজ্য এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফারুক খান।
উৎসঃ আমার দেশ