নজিরবিহীন ঘটনায় হুন্ডির আভাস এলসি ছাড়া ৭৬৯ গাড়ি আমদানি

0

এলসি ছাড়াই সাত শতাধিক গাড়ি আমদানিতে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনা নজিরবিহীন এবং এগুলো আনার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম মানা হয়নি। ২০০ কোটিরও বেশি টাকা দামের এসব গাড়ি চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে খালাস করা হয়েছে। দেশের আমদানি নীতি অনুযায়ী আমদানি করা ৭৬৯টি গাড়ি ডেলিভারি নিতে কমপক্ষে দুই কোটি ডলারের এলসি (প্রায় ২০০ কোটি টাকা) জাপানে পাঠাতে হবে। জাপানের বাংলাদেশি দুজন শীর্ষ রপ্তানিকারকসহ কয়েকজন রপ্তানিকারক এদেশের গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে এসব গাড়ি পাঠালেও ডলার সংকটের কারণে এলসি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। এখন কোনো ব্যাংক এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। এ কারণে এই গাড়ির বহর নিয়ে জাপানে রপ্তানিকারক এবং দেশে আমদানিকারকরা সংকটে পড়েছেন। চলতি মাসে নিয়ম ভেঙে আমদানি হওয়া এসব গাড়ি ‘জরিমানা দিয়ে’ হলেও খালাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিশেষ সুযোগ চেয়েছিল রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডা। সেই প্রেক্ষিতে এলসি ছাড়া আমদানি করা শত শত গাড়ি জরিমানার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে চট্টগ্রাম ও মোংলা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে, ঋণপত্র বা এলসি না খুলেই আমদানি করা হয়, শত শত গাড়ির দাম পরিশোধ করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এনবিআর’র নির্দেশেই গাড়িগুলো ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। দেরিতে হলেও যেসব গাড়ির এলসি হয়েছে, শুধু সেগুলোরই শুল্কায়ন হচ্ছে। এদিকে, গাড়ি আমদানিতে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ।

জাপান থেকে জাহাজীকরণের পর যেসব গাড়ির এলসি খোলা হয়েছে, সেগুলো থেকে ৪ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। আর বন্দরে পৌঁছার পর যেসব গাড়ির এলসি হয়েছে, সেগুলোতে শুল্কায়নযোগ্য দামের ৬ শতাংশ জরিমানা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মোটরযান সেক্টরের প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। গত কয়েক বছর ধরে নতুন গাড়ি আমদানির পরিমাণ বাড়লেও এক সময় রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এনে দেশের চাহিদা মেটানো হতো। এখনো নতুন গাড়ির পাশাপাশি জাপান থেকে প্রচুর পরিমাণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়। দেশের আমদানিকারকদের পাশাপাশি জাপানে বসবাসকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন শীর্ষ রপ্তানিকারক। এতে করে জাপানে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশের আমদানিকারক উভয়ই বাংলাদেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে বেশ সখ্য রয়েছে। আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারকের সখ্যভাবের কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের কিছু নীতিমালা এখানে উপেক্ষিত হয়। বিশেষ করে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে উভয়পক্ষই কিছুটা বাড়তি সুবিধা ভোগ করে।

প্রচলিত নীতি অনুযায়ী যে কোনো আমদানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ব্যাংকে এলসি খোলার পরই রপ্তানিকারক সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ করে। গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রেও একই নীতি পালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি প্রচলিত নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশি আমদানিকারকের কাছে জাপানের রপ্তানিকারকরা ব্যাংকের এলসি ছাড়া গাড়ি পাঠিয়ে দেন। এভাবে গাড়ি জাহাজীকরণের সুযোগ না থাকলেও আমদানি-রপ্তানিকারক মিলেমিশে এবং শিপিং এজেন্সিকে ম্যানেজ করে গাড়ির বহর পাঠিয়ে দেয়। কথা ছিল গাড়ি বন্দরে পৌঁছার আগেই এলসি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে গাড়িবাহী জাহাজ বন্দরে পৌঁছার আগে এলসি পাঠিয়ে দেওয়া হলে বিষয়টি নিয়ে কেউ আর উচ্চবাচ্য করতেন না। কোনো সংকটও হতো না।

এলসিবিহীন গাড়িতে সয়লাব বন্দর : আচমকা চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দর গাড়িতে সয়লাব হয়ে উঠে। এনওয়াইকে শিপিং লাইন্সের রো রো ভেসেল লোটাস লিডার এবং ইসিএল শিপিং লাইসেন্সের জাহাজ মালয়েশিয়া স্টারে বিপুলসংখ্যক গাড়ি চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পৌঁছে। এরমধ্যে প্রাডো, হ্যারিয়ার, প্রিমিও, এলিয়নসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৭৬৯টি গাড়ির কোনো এলসি নেই। প্রচলিত নিয়মে আইজিএমে রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং ব্যাংকের নাম থাকে। কিন্তু এসব গাড়ির আইজিএমে শুধু আমদানিকারকের নাম রয়েছে। এতে করে এসব গাড়ির বিএল ইস্যু করা সম্ভব হচ্ছে না। শিপিং এজেন্সির পক্ষ থেকে বিএল ইস্যু করতে না পেরে মারাত্মক রকমের সংকটে পড়েছে। আমদানিকারকের সঙ্গে এলসি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে মোংলা বন্দরের ৩০টি দামি গাড়ির চাবি নিয়ে যায় শিপিং এজেন্সি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনার জন্য গাড়িগুলো সরাতে গেলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম বন্দরে ২১৯টি এবং মোংলা বন্দরে ৫৫০টি গাড়ির কোনো এলসি নেই।

গাড়িগুলোর অধিকাংশই এনেছেন বারভিডার একজন নেতা। জাপানে বসবাসকারী বাংলাদেশি গাড়ি ব্যবসায়ী ড. জহির এবং মেজবাহউদ্দীনসহ কয়েকজন রপ্তানিকারক এসব গাড়ি রপ্তানি করেছেন। তবে এলসি না যাওয়ায় রপ্তানিকারকরাও মারাত্মক রকমের বেকায়দায় পড়েছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বন্দরে খালাস হওয়া গাড়িগুলোর মালিকানা নিয়ে তারা সংকটে পড়তে যাচ্ছেন বলেও সূত্র আভাস দিয়েছে। এলসি ছাড়া গাড়িগুলো শিপিং লাইন্স কিভাবে জাহাজীকরণ করল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গাড়ি আমদানির কথা স্বীকার করে বলেছেন, এগুলোর এলসি আছে কি নেই তা দেখার দায়িত্ব বন্দরের নয়। বিষয়টি শুল্কায়নে সংকট তৈরি করবে, বন্দরের নয়। বন্দর ৩০ দিন গাড়ি দেখবে। এরমধ্যে নোটিং না হলে গাড়ি নিলামে তোলার জন্য কাস্টমসে জানিয়ে দেবে। বন্দর শুধু ভাড়ার মালিক, গাড়ির নয় বলেও উল্লেখ করেন তারা।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। এটা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এখানে বড় ধরনের নজিরবিহীন অনিয়ম হয়েছে যা ইতঃপূর্বে কখনো হয়নি।

এই সেক্টারের ব্যবসায়ী মাখন দাস বলেন, এখানে যে বিষয়টা হয়েছে তা স্পষ্টতই হুন্ডি করে টাকা পাঠানো হয়েছে। এখানে সিন্ডিকেট করে কাজটি করা হয়েছে। দেখেন এখানে নতুন গাড়ি এনে যদি বলে রিকন্ডিশন আপনাকে সেটাই বিশ্বাস করতে হবে। কারণ এই কাজটি সুপরিকল্পিতভাবে করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করতেই এই কারসাজি। আর বেশিকিছু বললে আবার আমি নাই হয়ে যাব।

jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More