সরকারের মুখোমুখি সংসদ

0

songsodজাতীয় সংসদে উত্থাপিত এমপিদের ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় নতুন করে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী তো বটেই আমলাদের (সচিব) চেয়েও কম সম্মানী ভাতার বিধান রেখে করা বিলটি পাসের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে একেবারেই। সেই সঙ্গে পাসের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিলগুলোও আটকে যেতে পারে সংসদে। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে অনেকটা অঘোষিত মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে সংসদের। যে কারণে ভাতা বৈষম্যে ক্ষুব্ধ এমপিরা নিজেদের সম্মানী ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি সমাধানের আগে এসব বিলে সম্মতি নাও জানাতে পারেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে।
এদিকে এমপিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক এই আচরণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত করা হয়েছে অভিযোগ তুলে এজন্য আমলানির্ভর মন্ত্রীদেরই দায়ী করছেন এমপিরা। তারা বলছেন, আমলাদের প্ররোচনায় মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এই বিলটির খসড়া অনুমোদন করেছেন মন্ত্রীরা। এর সবটাই ভুল হয়েছে দাবি করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যথাযথ সম্মানের জায়গায় রেখে বিলটি নতুন করে প্রস্তুত করতে বলছেন এমপিরা। এর মাধ্যমে জনগণকেই অসম্মান করা হয়েছে দাবি করে জনগণের সম্মান রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে নওগাঁ-৬ আসনের এমপি ইসরাফিল আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে মানবকণ্ঠকে বলেন, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এমপিদের সম্মান এবং মর্যাদা সচিবদের অনেক উপরে। অথচ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রস্তাবিত বিলে এমপিদের সম্মানী তাদের চেয়ে অনেক অনেক কম রাখা হয়েছে। বৈষম্য করা হয়েছে ভাতাদির ক্ষেত্রেও। এটি চরম অমর্যাদার উল্লেখ করে সরকারদলীয় এই এমপি বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই। আমলারা যা লিখে দিয়েছেন কোনো ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই মন্ত্রীরা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এমপিদের এক বছরের ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স ধরা হয়েছে (মাসে ৬ হাজার টাকারও কম) মাত্র ৭০ হাজার টাকা। এটি কোন বিবেচনাবোধ থেকে করা হয়েছে? অথচ রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালী এমনকি আমলাদেরও গাড়ি এবং গাড়ির জ্বালানি খরচ হচ্ছে আনলিমিটেড। বিষয়টি খুব দ্রুতই বিবেচনায় নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদের চলমান নবম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, বিচারপতি এবং এমপিদের ভাতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত     পৃথক চারটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি বিলই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র এমপিদের ভাতা বৃদ্ধির বিলটি ছাড়া অন্য বিলগুলো পাসের জন্য সংসদে অপেক্ষমাণ রয়েছে।
বিলের প্রস্তাবানুযায়ী রাষ্ট্রপতির বেতন ৬১ হাজার ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি বিমানে ভ্রমণ করলে তার বীমার জন্য আগের ১৫ লাখ টাকার পরিবর্তে আইন সংশোধনের পর ২৭ লাখ টাকা হারে তা পাবেন। তবে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন তহবিলে আগের মতোই দুই কোটি টাকা থাকবে। নতুন বিলে প্রধানমন্ত্রীর বেতন ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। সুবিধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি বাড়িতে থাকলে প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ পাবেন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। আইন সংশোধনের পর প্রধানমন্ত্রীর বিমানভ্রমণের বীমার সীমা ১৪ লাখ টাকার পরিবর্তে ২৫ লাখ টাকা হারে পাবেন। এছাড়া ঢাকার বাইরে গেলে প্রধানমন্ত্রীর দৈনিক ভাতা ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা এবং স্বেচ্ছাধীন তহবিলের আকার ১ কোটি থেকে বাড়িয়ে দেড় কোটি টাকা করা হয়েছে।
মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে পূর্ণ মন্ত্রী ও সমপর্যায়ের উপদেষ্টাদের বেতন ৫৩ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রীদের ব্যয় নিয়ামক ভাতা ৬ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। মন্ত্রীরা বেসরকারি বাড়িতে বসবাস করলে বাসা ভাড়া পাবেন ৮০ হাজার টাকা। আগে এর পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার টাকা। তবে মন্ত্রীরা স্বেচ্ছায় বেসরকারি বাড়িতে বসবাস করলে এখন ২৫ হাজার টাকা ভাতা পান। এছাড়া মন্ত্রীদের বিমান ভ্রমণে বীমার সীমা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৮ লাখ, দৈনিক ভাতা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা এবং স্বেচ্ছাধীন তহবিলের আকার ৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী ও সমপর্যায়ের উপদেষ্টাদের বেতন ৪৭ হাজার ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯২ হাজার টাকা করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীদের ব্যয় নিয়ামক ভাতা ৪ হাজার থেকে বেড়ে সাড়ে সাত হাজার টাকা, বেসরকারি বাড়িতে বসবাসের ক্ষেত্রে ভাতা ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার, বিমানভ্রমণে বীমার সীমা ৫ লাখ থেকে ৮ লাখ, দৈনিক ভাতা ৭৫০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা এবং স্বেচ্ছাধীন তহবিলের আকার ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ লাখ টাকা হচ্ছে। এছাড়া উপমন্ত্রীর বেতন ৪৫ হাজার ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা, ব্যয় নিয়ামক ভাতা ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা, বেসরকারি বাড়িতে বসবাসের ভাতা ৪০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৭০ হাজার টাকা, বিমানভ্রমণে বীমার সীমা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৮ লাখ টাকা, দৈনিক ভাতা ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা এবং স্বেচ্ছাধীন তহবিলের পরিমাণ ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।
এদিকে এমপিদের সম্মানি ভাতা ২৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। এরসঙ্গে কনস্টিটিউন্সি অ্যালাউন্স (আর্টিকেল-৩/এ) ১২ হাজার ৫০০ টাকা, নিয়ামক ভাতা ৫ হাজার টাকা, ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স ৭০ হাজার টাকা (বার্ষিক), অফিস ব্যয় বাবদ ৯ হাজার টাকা, লন্ড্রি অ্যালাউন্স ১৫০০ টাকা, বিবিধ খরচ ভাতা ৬ হাজার টাকা, ভ্রমণ ভাতা প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা করে। দৈনিক ভাতা (স্বাভাবিক) ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা (স্বাভাবিক) ৭৫ টাকা, ডেইলি অ্যালাউন্স (অধিবেশনকালীন) ৮০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা (অধিবেশনকালীন) ২০০ টাকা, বিদেশ ভ্রমণ ভাতা (বার্ষিক) ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭০০ টাকা, টেলিফোন ভাতা ৭ হাজার ৮০০ টাকা। এর বাইরে ঐচ্ছিক অনুদান ৫ লাখ এবং বীমা বাবদ ১০ লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদে এমপিদের ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত এই বিলটি উত্থাপিত হওয়ার পরই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন এমপিরা। তারা এর বিরোধিতা করে তাদের সম্মানহানী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সদস্যরাও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিলটি পাসের জন্য চূড়ান্ত করেননি। এ নিয়ে বিল প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা এবং অর্থমন্ত্রীকে কমিটির বৈঠকে তলব করেন। যদিও এদের কেউই বৈঠকে হাজির হননি।
সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েক এমপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবকণ্ঠকে জানান, নতুন বেতন স্কেল অনুযায়ী একজন সচিবের বেতন ধরা হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। এছাড়া অন্যান্য ভাতাদির সঙ্গে গাড়ি ও গাড়ির জ্বালানি সেবা গ্রহণ করেন আনলিমিটেড। অথচ এমপিদের নিজের টাকায় গাড়ি নিতে হচ্ছে। জ্বালানি খরচ দেয়া হয় অপ্রতুল। এর মধ্যে সম্মানী ভাতা দেয়ার নামে সম্মানহানিকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে। যা মেনে নেয়া খুবই কষ্টসাধ্য ও বেদনাদায়ক। তারা বলেন, একজন এমপির সম্মান তো সাংবিধানিকভাবেই আমলাদের অনেক উপরে। সেক্ষেত্রে তাদের সম্মানিভাতা কোন বিবেচনাবোধ থেকে আমলাদের চেয়ে কম রাখা হয়েছে তা রোধগম্য হচ্ছে না। যথাযথ সম্মানী ধার্য করে বিলটির অতিদ্রুত সমাধান চান তারা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More