‘আমরা তো মরেই যাবো, টাকাগুলো তোমরা রাখো’

0

hottel gulshanwজঙ্গিরা বলে ‘আমরা তো মরেই যাবো, টাকাগুলো তোমরা রাখো’
নিউজ ডেস্ক : এমন ভয়াবহ নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশে আর কখনও ঘটেনি। রাজধানীর গুলশানের ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ রেস্টুরেন্টে শুক্রবারের ওই হামলায় জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নৃশংসতার শিকার হন দেশী-বিদেশী ২০ জন। শুধু তাই নয়, তাদের হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। রেস্টুরেন্টটির উদ্ধার হওয়া কর্মচারীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে সন্ত্রাসীদের সেদিনের নৃশংসতার কিছু চিত্র।[ads1]

তখন রাত পৌনে ৯টা। রেস্টুরেন্টটির নিচতলার একদম সামনের একটি টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন ১০-১২ জন বিদেশী অতিথি। জঙ্গিরা রেস্টুরেন্টটিতে প্রবেশ করে প্রথমেই তাদের ওপর গুলি চালায়। একের পর এক গুলি। বাঁচাও, বাঁচাও, হেল্প, হেল্প- বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন অতিথিরা। মুহুর্মুহু গুলির মধ্যেই চেয়ার ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন কেউ কেউ। কর্মচারীদের কেউ টয়লেটে, কেউ রান্নাঘরে, আবার কেউ বা স্টোররুমে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ছাদে ওঠেন এবং সেখান থেকে লাফ দিয়ে বাইরে চলে আসেন। রেস্টুরেন্টটির কর্মচারী ও অতিথিদের জিম্মি করে সারারাত লাশের পাশেই রাখে জঙ্গিরা। কয়েকজন কর্মচারীকে আটকে রাখা হয় টয়লেটের ভেতর। জিম্মিদের মধ্যে যারা মুসলিম ছিলেন তাদের সেহরির জন্য খাবার রান্না করে পরিবেশন করার নির্দেশও দেয় সন্ত্রাসীরা।

রেস্টুরেন্টটির কর্মচারী ইমাম হোসেন সবুজ রোববার বলেন, তিনি তখন কাজ করছিলেন। হঠাৎ দেখেন কয়েকজন ঢুকে সামনের টেবিলে থাকা অতিথিদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। এ সময় তিনিসহ ৫-৬ জন কর্মচারী একটি ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন। প্রায় ১০ মিনিট গুলির শব্দ শুনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, গুলির শব্দ শেষ হওয়ার পরপরই সন্ত্রাসীরা আমাদের ওই ঘর থেকে বের করে আনে। বলে, আপনাদের ভয় নেই। আপনাদের মারতে আসিনি। বিধর্মীদের মারতে এসেছি। আমরাও মরতে এসেছি। আপনারা নির্ভয়ে থাকেন। ভয়ের কারণ নেই। এরপর দু’জন কর্মচারীকে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেস্টুরেন্টের সব জায়গায় যায়। ঢোকার পথগুলো দেখে। অন্য কক্ষে লুকিয়ে থাকা কয়েকজনকেও ধরে নিয়ে আসে। অতিথিসহ কর্মচারীদের জিম্মি করে একদিকে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে বলে।
সবুজ বলেন, সিঁড়িতে, সিঁড়ির নিচে ও ফ্লোরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তাক্ত অবস্থায় মানুষ পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠি আমরা। সবাই কাঁপতে থাকি। এ সময় পড়ে থাকাদের মধ্যে যারা নড়াচড়া করছিলেন, তাদের কারও গলা কেটে, কারও মুখ, কারও বুকে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে জঙ্গিরা। কয়েকজনকে কুপিয়েও খুন করা হয়। সন্ত্রাসীদের একজন জানতে চান, এখানে এক বিদেশী সেফ আছে, সে কোথায়? জানেন না বলার পরও রান্নাঘরসহ বিভিন্ন[ads2]

কক্ষে গিয়ে তন্নতন্ন করে আর্জেন্টাইন সেফ দিয়াগোকে খোঁজে তারা। কিন্তু তাকে খুঁজে পায়নি।
ইমাম হোসেন সবুজ জানান, ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা লাশের মধ্যেই একটি টেবিলে সবুজসহ ৪-৫ জন কর্মচারীকে বসতে বলে তারা। সবাইকে মাথা নিচু করে রাখতে বলা হয়। আর পাশের একটি টেবিলে বসিয়ে রাখা হয় কয়েকজন অতিথি নারী-পুরুষকে। সবুজ বলেন, ভয় পাচ্ছিলাম- আমাদেরও হয়তো মেরে ফেলবে ওরা। ওদের সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো ছুরি। কেউ আমাদের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র হাতে ঘুরছে। ছাদেও নিয়ে গিয়েছিল কয়েকজন কর্মচারীকে।
রাতে কর্মচারীদের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় তারা আরবি, ইংরেজি ও বাংলায় কথা বলে। আরবিতে বলার পর বাংলায় তর্জমা করিয়েও শোনায়। কর্মচারীদের কাছে জানতে চায়, এখানে বিধর্মীদের খাওয়ানোর চাকরি তারা কেন করে। বলে, হারাম-হালাল বুঝে চাকরি করবেন। একটি টেবিলে মদের বোতল দেখে সন্ত্রাসারী জানতে চায়, এই রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রি করা হয় কিনা। উত্তরে কর্মচারীরা জানান, না, এখানে মদ বিক্রি হয় না। তবে বিদেশীরা মদ সঙ্গে করে এনে এখানে খায়। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, লাইসেন্স না থাকলেও রেস্টুরেন্টটিতে নিয়মিতভাবে মদ বিক্রি করা হতো।
রাতে এক সময় রেস্টুরেন্টে থাকা বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার এনে এক জায়গায় জড়ো করে সন্ত্রাসীরা। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, প্রয়োজনে গ্যাস সিলিন্ডারগুলোতে গ্রেনেড মেরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো ভবন উড়িয়ে দেয়া হবে। এ সময় তাদের কেউ কেউ বলছিল, বিস্ফোরণ ঘটালে তো তাদের সঙ্গে কর্মচারী ও জিম্মি অতিথিরাও মারা পড়বে। সন্ত্রাসীরা বলাবলি করে, এই রেস্টুরেন্টে তো আরও অনেক বিধর্মী থাকার কথা। আজ অল্প কেন। এরপর বলে, যেগুলো পেয়েছি তাদের মেরে সফল হয়েছি।
সেই রাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সবুজ আরও জানান, অতিথি জিম্মিদের খাবার ও পানি দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। তাদের একজন মুসলমান জিম্মিদের সেহেরির জন্য ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে কর্মচারীদের রান্না করে আনতে বলে এবং তা খেয়ে রোজা রাখতে বলে। কর্মচারী ও অতিথিদের বলে, এখান থেকে উদ্ধার হওয়ার পর বাইরে গিয়ে এই অ্যাডভাঞ্চার সম্পর্কে মানুষকে জানাতে। কিভাবে সন্ত্রাসীরা মানুষকে গুলি ও কুপিয়ে মেরেছে তা বাইরে জানাতে বলা হয়। ভোরে নিজেদের কাছে থাকা কিছু টাকা কর্মচারীদের দিয়ে সন্ত্রাসীরা বলে, আমরা তো মরেই যাব। টাকাগুলো  তোমর রাখ।
রেস্টুরেন্টটিতে থালাবাটি পরিষ্কার করতেন বাচ্চু। তিনি বলেন, সেফ দিয়াগোসহ আমরা ৬ জন কিচেনে কাজ করছিলাম। এসময় ঠাসঠাস গুলির শব্দ শুনি। একনাগাড়ে শব্দ হচ্ছে। মানুষ চিৎকার দিচ্ছে। আমরা সবাই আতংকিত। আমরা ভেতর দিয়ে ছাদে উঠে পড়ি। দেখি ছাদের ওপর আরও ১০-১২ জন আমাদের স্টাফ লুকিয়ে আছে। সেফ দিয়াগো ও আমি ছিলাম ছাদের একপাশে। তখনও বিকট শব্দ হচ্ছিল। রেস্টুরেন্ট ও পাশের ভবনের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় আমি ও সেফ লাফ দেই। ওই বাড়ির বাউন্ডারি প্রাচীরে পড়ি আমি। তারকাঁটায় আমার দুই হাত ছিঁড়ে যায়। আমরা দু’জন মাটিতে বসে প্রাচীর ঘেঁষে চুপ করে বসে থাকি। তখনও বিকট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বাচ্চু জানান, প্রায় এক ঘণ্টা তিনি ও দিয়াগো সেখানে থাকার পর পুলিশ ওই দুই ভবনের মাঝখানের দরজা খোলে। তারা বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন, এই বুঝি সন্ত্রাসীরা গুলি চালাবে।[ads1]

একটু সময়ের মধ্যে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ২-৩ মিনিটের মধ্যে আবার দরজা খোলা হয় বাইরে থেকে। বাচ্চু বলেন, দরজার দিকে তাকিয়ে মাথায় হেলমেট পরা দেখে বুঝি তারা পুলিশের লোক। পুলিশকে বলি, হেল্প মি। হেল্প মি। এরপরই পুলিশ আমাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বাচ্চু বলেন, আমরা প্রাণে বেঁচে এসেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।
ওই রেস্টুরেন্টের কিচেনের কর্মী সমীর বাড়ৌ ও তার ভাগ্নে রিন্টু কীর্তনিয়া জিম্মিদশা থেকে উদ্ধারের পর বাসায় ঘটনা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছে। সমীর ও রিন্টুসহ ৬-৭ জনকে একটি টয়লেটে আটকে রাখে সন্ত্রাসীরা। সারা রাত কেটেছে মৃত্যু ভয়ে। রিন্টু জানায়, সকালে যখন সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে, তখন গুলির শব্দে তারা আবারও আঁতকে ওঠে। বাথরুমের দিকেও গুলি আসছিল। একপর্যায়ে তাদের কয়েকজন টয়লেটের ভেন্টিলেটার দিয়ে নিজেদের পরিচয়পত্র দেখান, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের ডিউটি পোশাক খুলে তা সেনা কমান্ডোদের দেখান।
এদিকে জঙ্গিদের হাতে জিম্মি অবিন্তা কবীর, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও ভারতীয় তরুণী তারুশি জৈন সেখানে গিয়েছিলেন পরস্পর সাক্ষাতের জন্য। জঙ্গিরা ফারাজকে চলে যেতে বললেও অন্য দুই বন্ধুকে রেখে যেতে রাজি হয়নি। পরে তাদের তিনজনকেই খুন করে সন্ত্রাসীরা।[ads2]

উদ্ধার হওয়া এক কর্মী জানান, রাতে একপর্যায়ে আরেক বাংলাদেশী ইশরাত আখন্দের পাশে এসে দাঁড়ায় দুই জঙ্গি। নাম জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে ইশরাত তখন জানান, তিনি বাংলাদেশেরই নাগরিক এবং মুসলিম। তখন এক জঙ্গি বলে, মুসলমান হলে হিজাব পরেনি কেন? মাথায় কাপড় নেই কেন? ইশরাতকে নিয়ে দুই জঙ্গি আলোচনা করে। কিছ্ক্ষুণ পর তৃতীয় এক জঙ্গি এসে বলে, হাতে বেশি সময় নেই। এরপরই এক জঙ্গি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারে ইশরাতকে।-যুগান্তর

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More