ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ে অন্ধকারে সরকার

0

educationসরকারের নজরদারির অভাবে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো গলাকাটা ফি আদায় করছে। ভর্তি ফি, পুনঃভর্তি, সেশন ফির নামে শিক্ষা বাণিজ্য চালাচ্ছে। অন্যদিকে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড নিয়ে অন্ধকারে সরকার। আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ঝুলে আছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনা নীতিমালা। প্রায় চার বছর ধরে নীতিমালা প্রণয়ন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা নির্ধারণের কাজ আলোর মুখ দেখেনি। এক বছর আগে হাইকোর্ট নীতিমালা করার জন্য নির্দেশনা দিলেও তা এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি। নির্ধারিত হয়নি দেশে কতটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।

[ads1]
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইংরেজি মাধ্যমে চার ধরনের স্কুল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রাইমারি বা কিন্ডারগার্টেন স্কুল। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। মাধ্যমিক ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অনুমোদন দেয় মাউশি। ‘ও’ (অর্ডিনারি) লেভেল এবং ‘এ’ (অ্যাডভান্সড) লেভেল প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয় শিক্ষা বোর্ড। এসব স্কুলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চা তেমন একটা হয়না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও দেশীয় পাঠ্যপুস্তকের বালাই নেই। পাস করে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে না। পাড়ি জমায় বিদেশে। এক এক স্কুলে এক এক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবই পড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে কেউ ব্রিটিশ পদ্ধতিতে ক্যামব্রিজ বা এডেক্সেল, অনেকে অস্ট্রেলিয়ান আবার কেউ ভারতীয়, কানাডিয়ান, তুর্কিসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম ও সিলেবাসে অনুসরণ করছে।
শিক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো ভর্তি ফি, টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফির বিষয়ে মনিটরিং করতে পারে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানে না। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেদের খেয়াল খুশিমতো পরিচালিত হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক সময় ধনী শ্রেণীর শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে পরিচিত পেলেও বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানরা পড়াশোনা করছে। অভিযোগ আছে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এ ধরনের স্কুলের প্রসার বেশি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার চর্চা হয় না। দেশের জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি অবহেলিত।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রুলে দেশে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল পরিচালনায় একটি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না জানতে চান। রুলে এসব স্কুলে মাসিক বেতন, পুনঃভর্তি ফি বা সেশন চার্জ আদায়ের বিষয়ে নীতিমালা তৈরি এবং তদারক সেল গঠনের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কখনো নীতিমালার খসড়া করে মতামত নেয়ার নামে ফাইল চালাচালির আড়ালে সময়ক্ষেপণ করা হয়। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ফাইল চালাচালিতেই কাটিয়ে দেয়া হয় সময়।[ads2]
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুলস অর্ডিন্যান্স-১৯৬২-এর অধীন সরকার ২০০৭ সালে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে। সে অনুযায়ী বেসরকারি (ইংরেজি মাধ্যম) বিদ্যালয়ের সাময়িক নিবন্ধন নেয়ার বিধান রয়েছে। তবে এর কোনো তোয়াক্কা করে না এসব প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় বড় দুটি জঙ্গি হামলায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের ছবি আইএস প্রকাশ করেছিল, যারা সবাই গত কয়েক মাস নিখোঁজ ছিলেন। তারা পরিবারের যোগাযোগের বাইরে ছিলেন বলে স্বজনরা জানান। এরপর ঈদের দিন শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় পুলিশের গুলিতে নিহত যুবকও গত মার্চ থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়। এই ছয়জনের মধ্যে চারজনই বিভিন্ন ব্যয়বহুল ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে লেখাপড়া করেছেন।
দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিদেশি শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে দেশীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এখনই উপযুক্ত সময় সন্ত্রাসবাদ কার্যক্রম ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততার পর্যবেক্ষণ। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর কার্যক্রম সরকারের তদারকি করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। তারা বলেন, ইংরেজি মাধ্যমের এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের মনিটরিংয়ের বাইরে রয়েছে।
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল জিএম নিজাম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, মাদকাসক্ত বা সাম্প্রতিক উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া শুধুমাত্র ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়। সমাজের সবক্ষেত্রে এটি বিদ্যমান। তিনি বলেন, সম্পদশালী পরিবার থেকে আসা এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা দক্ষতা ও প্রযুক্তি জ্ঞানকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। তিনি জানান, সাম্প্রতিক ঘটনায় সংগঠনটি এক বৈঠকে স্কুলে সংস্কৃতি ও খেলাধুলা কার্যক্রম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া পরিবারে সন্তানকে মা-বাবার আরো বেশি সঙ্গ ও সময় দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনা নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে দাবি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রুহি রহমান জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তদারকির জন্য নিয়মিত পরিদর্শনের বিষয়টি সংযুক্ত করছি। খসড়া অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নবায়ন করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নীতিমালায় ভর্তি ও টিউশন ফি  নির্ধারণে ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। নীতিমালা প্রণয়নের পর এসব প্রতিষ্ঠানগুলো মনিটরিং করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ারা বিদেশি সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে মাদকাসক্ত এবং জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে। [ads2]

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More