উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন

0

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। চলছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে দুই দলে নেতারা একে অপরের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও বসে নেই। এসব দলের নেতারা কেউ ছুটছে বিএনপির দিকে আবার কেউ দেশের রাজনীতির সুবাতাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইনালি রাজনীতির বাতাস বইবে যে দিকে সেদিকেই সুযোগ নেওয়ার অপেক্ষায় অনেকে।

দেশের বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে চলতি বছরের ১১ আগস্ট থেকে। জ্বালানি তেল, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান-সহ দলের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও গুম-খুনের প্রতিবাদে ওই দিন ঢাকায় সমাবেশ করে দলটি। সমাবেশ থেকে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেয় তারা। বিএনপির এই আন্দোলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেশের বিভিন্নস্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলছে। সবশেষ শুক্রবার (১১ নভেম্বর) রাতে দুর্বৃত্তদের হাতে হত্যার শিকার হন বাগেরহাট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম ভূঁইয়া তানু। এর ৫দিন আগে ৬ নভেম্বর সিলেটে খুন হন বিএনপি নেতা আ ফ ম কামাল।

মূলত দেশে গুম-খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দায়ী করে পুলিশ ও র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর থেকে আন্দোলনে শক্তি পায় বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২২ আগস্ট ভোলায় বিএনপির ডাকে কর্মসূচীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী আব্দুর রহিম ও ভোলা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নূরে আলম। মূলত এরপরই ভিন্নদিকে মোড় নেয় বিএনপির আন্দোলনের রুট। যদিও আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদে জ্বালানি তেল, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের আগে দেশের রাজনীতির অঙ্গন ছিল নিরব।

এরপর বিএনপির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শুরু হয় আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের শাসনামলে রাজনীতির আরেক নতুন অধ্যায়। সারাদেশে নতুন নতুন কৌশলে বিএনপি শুরু করে আন্দোলন কর্মসূচী। পহেলা সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশে কর্মসূচী ঘোষণা করে দলটি। ওইদিন নারায়ণগঞ্জে শোভাযাত্রায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের। পুলিশের গুলিতে নিহত হন যুবদল কর্মী শাওন। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ শহরের মুক্তারপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন যুবদল নেতা মো. শাওন। একদিন পর ২২ সেপ্টেম্বর রাতে শাওনের মৃত্যু হয়।

এরপরই আরও তীব্রতা পায় বিএনপির আন্দোলন। সারাদেশে শুরু হয় বিক্ষোভ। যুবদল কর্মী নিহতের একদিন পর ২ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয় বিএনপি-আওয়ামী লীগ। সংঘর্ষ শুরু হলে নিয়ন্ত্রণে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। এসময় বিএনপির তিন শতাধীক নেতা কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় বলে দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির আন্দোলনেরও রূপরেখায় আসে পরিবর্তন। তারা ঘোষণা করে সরকার বিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করা হবে। এই লক্ষ্যে ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকে বসেছে বিএনপি। তাদের রূপরেখা নিয়ে রাজধানীতে জোনভিত্তিক ও দশটি সাংগঠনিক বিভাগে কর্মসূচী ঘোষণা করে। বিএনপি নেতারা বলছে, তাদের আন্দোলনের তীব্রতা দেখেই সরকার নানাভাবে বাধা দিয়ে আসছে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বাধা সৃষ্টি করতে দুইদিন আগেই পরিবহণ বন্ধ, হামলা-সহ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে আওয়ামী লীগ। পুলিশ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতার করে হয়রানি করার অভিযোগ করছে বিএনপি।

বিএনপি বলছে, সারাদেশে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্র্মসূচীতে পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে। এছাড়া পুলিশও অতি উৎসাহী হয়ে নেতাকর্মীদের উপর গুলি চালানোর কথা বলছে বিএনপি।

এদিকে, ৭ নভেম্বর বিএনপির বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির সমাবেশে মিছিল নিয়ে যোগদান করাকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওইদিন জেলা শহরের স্টেশন রোডে জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে এ সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি করে।

এর একদিন আগে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট নগরীর আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামাল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেওয়া হয় একটি মোটরসাইকেলে।

অপরদিকে, বরিশালে বিএনপি সমাবেশের আগে ভোলার চরফ্যাশনে যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলায় যুবদল ও ছাত্রদলের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে। চরফ্যাশন থানার ওসি মুরাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষ করে বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হামলার ঘটনা ঘটে।

এছাড়া, বরিশালে সমাবেশ শেষে বাড়ি ফেরার পথেও নেতাকর্মীদের ওপর যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ করেছে বিএনপি।

এর আগে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে সেপ্টেম্বর মাসব্যাপী জোনভিত্তিক সমাবেশ করে দলটি। বিএনপি বলছে, ওই সমাবেশেও বিএনপির সঙ্গে কয়েকটি স্থানে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৫ সেপ্টেম্বর মিরপুরের পল্লবীতে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকে আহত হয়েছেন। ওই হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দায়ী করেছেন বিএনপি।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বনানীতে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ওই হামলায় বিএনপির নেতা তাবিথ আউয়ালসহ প্রায় অর্ধশতাধীক আহত হয়। হামলায় নিজেও আহত হয়েছেন উল্লেখ করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানও আহত হয়েছেন।

এদিকে, ১৪ অক্টোবর ময়মনসিংহে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীরা হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ বলেন, রাতে টাউন হল এলাকায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা করেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা। তবে ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নওশেল আহমেদ দাবি করেন, ছাত্রলীগ কোনো হামলা করেনি। রাস্তায় জনগণের চলাচল ও পুলিশের কাজে বাধা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা এবং পুলিশের তিন সদস্যকে আহত করার অভিযোগে বিএনপির ২৩ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে ৩৫০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ।

এদিকে, সংসদ বিলুপ্ত ও সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠণ করে সেই কমিশনের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে অনড় বিএনপি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করছি। বিএনপির প্রায় ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর নামে মামলা দিয়ে আসামি করা হয়েছে। তাদের মুক্ত করার জন্য আন্দোলন করছি। দেশের জনগণকে নিয়ে এই আন্দোলন। এই উপলক্ষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করা হবে। যদিও সম্প্রতি এক আলাচনা সভায় বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। এর পরই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও নড়েচড়ে বসেন। তারাও পাল্টা জবাব ছুঁড়ে দেন।

বিএনপির চলমান আন্দোলন সংগ্রামকে ঘিরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে চেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিদের বাঁচাতে চেয়েছে তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না।

গত ৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে তিনি মির্জা ফখরুলকে উদ্দেশ্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন বলছেন। তিনি তো মুক্তই। তাকে নিয়ে তো একটা মিছিলও করতে পারেননি আপনারা। তারেক রহমান মুচলেকা দিয়ে গেছেন তিনি রাজনীতি করবেন না। তারপর লন্ডনে বসে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে রাজনীতি চালাচ্ছেন। ১০ ডিসেম্বরে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে খেলা হবে।

সবশেষ শনিবার (১২ নভেম্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী ডিসেম্বরেই জনগণই বিএনপিকে লাল কার্ড দেখাবে বলে মন্তব্য করেছেন। ‘আওয়ামী লীগকে নয়, ডিসেম্বরে জনগণই বিএনপিকে লাল কার্ড দেখাবে’। তিনি বলেন, বিএনপির শাসনামলে পাঁচবার দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এই দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে খেলা হবে। তারেক রহমান অর্থপাচারকারী, মুচলেকা দিয়ে বিদেশে চলে গেছে, তার বিরুদ্ধেও খেলা হবে। এসময় দলীয় নেতাকর্মীদের এখন থেকেই প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান ওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

একইদিন ফরিদপুরে বিএনপির গণ সমাবেশে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘জোর করে কোনোদিন মানুষের সংগ্রামকে বন্ধ করা যাবে না। ইতিহাস ভুলে যান কেন? ভুলে যাবেন না ইতিহাস। একনায়কতন্ত্র করে জোর করে, মানুষকে গুম করে, খুন করে আপনার রেহাই পাবেন না।’ এসময় তিনি আওয়মী লীগের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াতে তরুণদের জেগে উঠার আহ্বান জানান। আস

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More