ডেটা সুরক্ষা আইন, বাংলাদেশ ছাড়তে পারে মার্কিন কোম্পানি: পিটার হাস

0

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ডেটা সুরক্ষা আইন যদি ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে।

রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে ‘বাংলাদেশে অনলাইন স্বাধীনতা ও ব্যবসায় বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

পিটার হাস বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা ও এখানে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির ইচ্ছার কথা জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের বাজার খুবই আকর্ষণীয়। আর এই কারণেই, আমরা সম্প্রতি দূতাবাসে একটি ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিস অফিস চালু করেছি। তবে একই সময়ে, আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই আশঙ্কার কথা শুনতে পাই যে, প্রস্তাবিত নতুন আইন ও প্রবিধানগুলো তাদের জন্য এখানে ব্যবসা করা আরও কঠিন করে তুলবে। এই বিষয়ে আমি একটু খোলামেলাভাবেই বলি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দিক থেকে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওভার-দ্য-টপ প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রণীত প্রবিধানগুলোর পাশাপাশি খসড়া ডেটা সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, আমরা যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের সাথে আমাদের অংশীদারত্বকে মূল্য দিই, তাই আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা সরকারের কাছে সরাসরি তুলে ধরেছি। আমি আমাদের কিছু উদ্বেগের কথা বলার আগে একথা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই- আমরা বাংলাদেশের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিকে শ্রদ্ধা করি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এবার তাহলে আমাদের কয়েকটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা বলি। আমরা উদ্বিগ্ন যে, ডেটা সুরক্ষা আইন যদি ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয় (আইনে পরিণত করা হয়) তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। একইভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি কোম্পানিগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তারা এখানে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। এর পরিণতি বাংলাদেশের জন্য খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রায় ২,০০০ এরও বেশি স্টার্টআপকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে। এবং প্রতিদিন যে কোটি কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারী তাদের সেবা নিচ্ছেন, তারা আর এই সেবাগুলো পাবেন না।

তিনি বলেন, আমরা সাম্প্রতিক ঘোষণার বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে ১৯১টি অনলাইন নিউজপোর্টাল ব্লক করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সমালোচনা গ্রহণ করার সক্ষমতা এবং অপ্রীতিকর বক্তব্য হলেও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা শক্তিশালী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস নাগরিক সমাজের অনেক সংস্থা এবং সাংবাদিকদের কাছ থেকে এই আইন বিষয়ে শুনেছে। তাদের ভয় হলো, এই নিয়ম ও আইন মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতাকে সীমিত করবে। ডেটা সুরক্ষা আইনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা উদ্বিগ্ন যে, ডেটা সুরক্ষা আইনের সর্বশেষ খসড়ায় একটি স্বাধীন ডেটা তদারকি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা রাখা হয়নি এবং এই আইনে ফৌজদারি শাস্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ তাদের স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে কিন্তু আমরা বাংলাদেশসহ সকল দেশকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই। অনলাইন বক্তৃতা এবং ডেটা সুরক্ষা করা সহজ কাজ নয়। এটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। আর সে কারণেই আমরা এই আলোচনা করছি।

পিটার হাস বলেন, ব্যবসাকে আকর্ষণ করার জন্য উদ্ভাবনের সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর এজন্য অনলাইন উম্মুক্ত ও স্বাধীন হওয়া দরকার। আর সেই সূত্রে পরবর্তী যে বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে সেটা হলো- মানবাধিকার। যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহারকারী ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য অনলাইন বিষয়বস্তু পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এবং এটি কোনো সহজ কাজ নয়। তবে আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের যে খসড়া আইন দেখেছি, সেখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এমন অনলাইন কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর সংজ্ঞার বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে, এই শতকে ডিজিটাল বিশ্বে বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করতে চায়। একইসাথে, পৃথিবী দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি দেশের সরকার ও সমাজ নতুন নতুন প্রযুক্তির দ্রুত গতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে এবং এই পরিবর্তনগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে সাজানোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা সবাই- সেটা যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্ব।

তিনি বলেন, আসুন, আমরা প্রথমেই অর্থনীতির বিষয় নিয়ে কথা বলি। এই শতকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত না করে বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষেই সফল হওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে আমাদের মিশনের কাজের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে একটি টেকসই ও যৌথভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া- এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তোলা, যা বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য উম্মুক্ত। আমরা আমাদের লক্ষ্যকে বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্যের সাথে মিলিয়ে নিয়েছি। একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বৃহত্তর পরিসরে অর্থনৈতিক সংযোগ গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশকে নেতৃত্বের আসনে স্থান করে দেবে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে আরও সংযুক্ত করতে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে বৈশ্বিক ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে আগ্রহ বোধ করেন এবং তারা একটি আমন্ত্রণমূলক পরিবেশ খুঁজে পান।

রাষ্ট্রদূত বলেন, আজকে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বাংলাদেশে অনলাইন স্বাধীনতা এবং ব্যবসায়িক বিনিয়োগের যোগসূত্র নিয়ে আলোচনা করার জন্য। প্রায় এক বছর আগে বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমি বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়া দেখে মুগ্ধ হয়েছি- সেটা ফুডপান্ডা থেকে বিকাশ এবং এর বাইরেও বিস্তৃত।

পিটার হাস বলেন, অনলাইন বিশ্ব আমাদের প্রচুর সুযোগের পাশাপাশি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও করেছে। বিশ্বের সব জায়গাতেই সরকারকে অবশ্যই অনলাইন ও এর সাথে যুক্ত থাকা ব্যবহারকারীর ডেটাকে দায়িত্বশীলতার সাথে পরিচালনা করার পাশাপাশি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করায় সচেষ্ট থাকতে হবে। এই ধরনের শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত জটিল একটা বিষয়। কারণ এটি আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার অপরিহার্যতা জড়িত ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এই কাজ করতে গিয়ে আমরা জানি যে, অসত্য/গুজব মোকাবেলা করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং ব্যবসার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা কতটা কঠিন। ওয়াশিংটন থেকে সিলিকন ভ্যালি পর্যন্ত আমাদের অনেক কিছুই শিখতে হয়েছে এবং আমরা এখনও শিখছি এবং এই ধরনের জটিল বিষয়গুলো নিয়ে আমরা খোলামেলাভাবে আলোচনা ও বিতর্ক করছি। কারণ শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ও নিরাপত্তা কোনভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না। এবং এই মূল্যবোধগুলো আসলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও একে অন্যকে শক্তিশালী করে। মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে ও টেকসই করে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।

পিটার হাস বলেন, আমরা বাংলাদেশ সরকারকে এই বিষয়গুলো নিয়ে বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে পরামর্শ করতে উৎসাহিত করি। এই ধরনের খোলামেলা আলোচনা হওয়াটা প্রশংসনীয়। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে, ডেটা সুরক্ষা আইনের পরবর্তী খসড়ায় উল্লেখিত খাতগুলোর সাথে আলোচনা থেকে পাওয়া মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং আমরা বিশ্বাস করি এতে বাংলাদেশের জন্য আরও ভালো হবে।

তিনি বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ডেটা সুরক্ষা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ডেটা সুরক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, অর্থনৈতিক সংযোগ এবং ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে উপযুক্ত ভারসাম্য গড়ে তুললে সেটা এই দেশের অব্যাহত উন্নয়নকে গতিশীল করবে। আমরা বাংলাদেশের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত অংশীদার এবং আমরা বাংলাদেশের সাফল্য দেখতে চাই।

উৎসঃ   বাংলা ইনসাইডার
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More