বাংলাদেশি পর্যটকদের দখলে কলকাতার নিউ মার্কেট

হোটেলের রুম পাওয়া নিয়ে হাহাকার; খাবারের মান নিয়েও অভিযোগ

0

উৎসবের মৌসুমে কলকাতায় দু’দিন কাটিয়ে চেন্নাইয়ে যাবেন মায়ের চিকিৎসার জন্য। এই পরিকল্পনা নিয়েই ভারতে গেছেন ময়মনসিংহের বাসিন্দা বাপি সরকার। কিন্তু শনিবার বিকালে কলকাতার নিউ মার্কেটে পৌঁছে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বাপি। তিন ঘণ্টা একাধিক হোটেলে ঘুরেও রুম পাননি তিনি। ফলে শীতের রাতে মার্কুইস স্ট্রিটের রাস্তায় লাগেজ নিয়েই রাত নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আকাশের নিচেই। এমনকি কি হোটেলের খোঁজে খাবারটুকুও জোটেনি তার পরিবারের চার সদস্যের।

এদিন রাতেই এই প্রতিনিধির মুখোমুখি হয়ে বাপি জানান, শনিবার বিকেল পাঁচটার সময় আমরা কলকাতা নিউমার্কেটে এসেছি। রাত আটটা বাজে এখন পর্যন্ত কোনো হোটেল পাইনি। ওই সময় পর্যন্ত ২০-২৫টা হোটেল খুঁজেছি, কিন্তু রুম পাইনি।

হতাশ হয়ে তিনি আরও জানান, এক রুমের জন্য ৬-৭, আবার কোথাও ৮ হাজার রুপি চাইছে। এখন কি করবো.. হয়তো রাতে বাইরেই থাকতে হবে। আমাদের সঙ্গে চারজন আছে। মাকে নিয়ে এসেছি, অসুস্থ মা চেন্নাই যাব ডাক্তার দেখাতে। এখানে আমরা দু’দিন থাকবো, দু’দিন পর চেন্নাই যাবো।

 

বাপি আরো জানান, নিউ মার্কেটের বাইরে রুম খালি আছে কিন্তু ১০ হাজার রুপি একদিনের জন্য চাইছে। ফলে সারাদিনে কিছু খাইনি, হোটেল পাইনি, খাবো কি। রুম পাব তারপর খাওয়া। আগে তো থাকার জায়গা পেতে হবে। মাকে যদি থাকতে না দিতে পারি খাব কি করে। রাস্তায় তো আর শোয়া যাবে না, ঘুমাতে তো হবে। এমন কোন দিন হয়নি আগেও এসেছি।

বাপির সাথেই রয়েছেন তারই মামা উৎপল সরকার। তিনি জানান, হোটেল খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত হয়ে গেছি, এটা বিরক্তিকর বিষয়, এখানে এসেই এইরকম পরিস্থিতির শিকার হলাম। খুব দাম চাইছে তাছাড়া হোটেলও পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে কেবল ময়মনসিংহের বাপি বা উৎপল সরকারই নয়, এরকম অসংখ্য বাপি বা উৎপল আছেন যারা এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন সাম্প্রতিককালে এই ছবি কলকাতার নিউমার্কেটে দেখা যায়নি।

শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু উড়ালপুল নিচ থেকে লিন্ডসে স্ট্রিট বরাবর যতদূর চোখ যায়-কেবল কালো মাথার সারি, কিংবা মার্কুইস স্ট্রিট বা সফর স্ট্রিট ডান কিংবা বাম দিক যেদিকেই তাকান না কেনো সেই একই দৃশ্য।

একে বড়দিন, তার উপর নতুন বছর- এই দুইয়ে মিলে বিকালের পর থেকে কলকাতার মিনি বাংলাদেশ বলে খ্যাত নিউ মার্কেটে পা ফেলার জায়গা নেই। শুক্র ও শনিবার এই দুই দিন বাংলাদেশে সরকারি ছুটির দিন। এর সাথে রবিবার জুড়ে ভ্রমণ প্যাকেজ বানিয়ে কলকাতায় উৎসবের আমেজ কাটাতে এসেছেন কয়েক হাজার ভ্রমণ পিপাসু বাংলাদেশি পর্যটক। ফলে যা হয়! এক কামরা হোটেল রুমের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও মিলছে না। যারা আগে থেকে হোটেল বুকিং করে কলকাতায় পা রেখেছেন তাদের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে হয়রানির সীমা নেই। বিকাল থেকে এক কামরার ঘরের খোঁজেও রাত আটটা পর্যন্ত শীতের কলকাতায় খোলা আকাশের নিচে বসে রয়েছেন।

ঝোঁপ বুঝে কোপ মারছেন হোটেল মালিকরাও। অভিযোগ এক হাজার রুপির হোটেল রুমের জন্য গুনতে হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার রুপি। কোথাও আবার ৭ হাজার রুপি পর্যন্ত দর হাঁকিয়েছেন হোটেল মালিকরা। অর্থাৎ ফেল কড়ি মাখো তেল! আবার রুম পেলেও তার গুণমানও নিম্ন।

শনিবার নিউ মার্কেট চত্বর, মার্কুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট একাধিক জায়গাতেই হোটেলের জন্য হাঁপিত্তেশ করে ঘুরতে দেখা গেল বেশ কিছু বাংলাদেশি পর্যটকদের। কেউ সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খুলতে চাইছেন না অনেকে আবার স্বপ্রতিভ হয়ে ক্যামেরার সামনে আসছেন।

ঢাকা থেকে শুক্রবার রাতে কলকাতায় আসা নাজনীন সুলতানা জানান, শুক্রবার রাত ৯টায় আমরা কলকাতা নিউ মার্কেটে এসেছি। তারপর কোন হোটেল পাইনি খুব ক্রাইসিস ছিল, কোন রকম ভাবে একটা হোটেল (ভিআইপি ইন্টারন্যাশনাল) পেয়েছি কিন্তু ভাড়া অনেক বেশি ছিল, প্রায় ৭ হাজার রুপি। ফলে কার্যত এক রাতের জন্য বাধ্য হয়ে ওটাই নিতে হয়েছে। শনিবার সকালে একটু কম বাড়ার অন্য হোটেলে ওঠেন তারা। হোটেলের মান ভালো।

স্বামীকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরের সামসেয়ার বেগমের আবার অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দালালকে বেশি পয়সা দিয়ে হোটেল পেতে হয়েছে। কিন্তু পরদিন সকালেই হন্যে হয়ে খুঁজে কমদামের হোটেল খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

তার স্বামী মো. লিয়াকত হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার কলকাতায় ঢুকি কিন্তু কলকাতায় ঢুকে দালালের খপ্পরে পড়তে হয়। এরপর হোটেল পাই। এছাড়াও একই সময়ে অতিরিক্ত পর্যটক আসার কারণে এই এলাকার হোটেলগুলোতেও পরিষেবা ঠিকঠাক করে পাওয়া যাচ্ছে না।

হোটেল মালিকরাও স্বীকার করেছেন ডিসেম্বরের ১৫ থেকে জানুয়ারির ১৫ পর্যন্ত পর্যটকদের চাপ এমনিতেই বেশি থাকে বিশেষ করে বাংলাদেশি পর্যটকদের। তিনি আরও জানান, হোটেলে এসে রুম না পেয়ে পর্যটকদের ফিরে যেতে হচ্ছে এমন ঘটনাও ঘটছে। পর্যটকদের চাপে হোটেলের ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে সে কথাও স্বীকার করে নেন তিনি। যদিও দালাল চক্রের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

তবে শুধু নিউ মার্কেটই নয়। একই ভিড় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনেও। সেখানকার অভিজ্ঞতাও তিক্ত বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকদের। সকাল আটটায় ঢুকে পাসপোর্টে ছাপ মারাসহ সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে বের হতে হচ্ছে রাত আটটায়। ফলে শহরে পৌঁছানোর আগেই বড়দিন বা নতুন বছর উদযাপনের আনন্দই নাকি মাটি হয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই বলছেন সীমান্তে পাসপোর্টে এরাইভাল বা ডিপারচার এর ছাপ মারাসহ প্রক্রিয়াটি আরো মসৃণ হলে ভালো হয়। নাজনীন সুলতানা, গত শুক্রবার দশটায় সীমান্ত পার করে পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষ করতে করতে বিকেল চারটা হয়ে যায়। প্রায় দশ হাজার মানুষের ভিড়। পৌষের এই ঠাণ্ডাতেই হিট স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা ছিল।

উৎপল সরকার জানান, বেনাপোল বর্ডারে এসে দেখি প্রচুর জ্যাম। আমাদের ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লেগেছে, ওখান থেকে বের হতে। ইমিগ্রেশনও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।

কিন্তু কেন এই নিউ মার্কেট? পর্যটকরা বলছেন মুসলিম হোটেল, রেস্তোঁরা, ভালো বাঙালি খাবার, শপিং মল, ঘোরার জায়গা, মানি এক্সচেঞ্জ, নিরাপত্তা, সর্বোপরি যোগাযোগের ব্যবস্থা। আলপিন টু এলিফ্যান্ট- সবকিছুই এক ছাতার তলায়।

Bd pratidin

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More